ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ৬ আসনেই গ্রুপিং, রুমিনসহ অর্ধশত প্রার্থী মাঠে
মো. ফজলে রাব্বি, ব্রাহ্মণবাড়িয়া
প্রকাশ: ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০:০৭ এএম
নেতৃত্বের প্রতিযোগিতায় গ্রুপিং একটি সাধারণ ঘটনা। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ছয়টি আসনেই গ্রুপিং চলছে। বিএনপির অর্ধশত প্রার্থী মাঠে। কর্মিসভা, সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে নির্বাচনি মাঠ গোছাচ্ছেন মনোনয়নপ্রত্যাশীরা।
নানা অনুষ্ঠানে তাদের সরব উপস্থিতি যেন নির্বাচনের আগমনী বার্তা দিচ্ছে। সপ্তাহের শুক্র-শনিবার এ দুদিন বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যোগ দিচ্ছেন তারা। সম্ভাব্য প্রার্থীরা বিভিন্ন এলাকায় কর্মী সভা, আলোচনা সভাসহ সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে অংশ নিচ্ছেন। এতে দলের অভ্যন্তরে নির্বাচনি আমেজ বিরাজ করছে। মনোনয়ন পেতে যার যার মতো করে কেন্দ্রেও যোগাযোগ বাড়িয়েছেন। আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে জেলার সবকটি আসন থেকে অর্ধশতাধিক বিএনপির প্রার্থী মাঠে কাজ করছেন।
অন্যদিকে গ্রুপিং আর দলীয় কোন্দল প্রকাশ্যে এসেছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আহ্বায়ক কমিটিসহ প্রতিটি উপজেলা শাখা বিএনপিতে। দেখা দিয়েছে সংগঠনের মধ্যে বিভক্তি। জেলার ৯টি উপজেলায়ই ২ থেকে ৩টি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে আছে বিএনপি। সম্প্রতি ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৪ (কসবা-আখাউড়া) আসনে পুরনো ত্যাগী নেতাকর্মীদের বাদ দিয়ে কমিটি করা হচ্ছে বলে অভিযোগ জমা পড়েছে কেন্দ্রীয় শীর্ষ নেতাদের কাছে। অভিযোগ তদন্ত করতে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশে সোমবার (৯ ডিসেম্বর) কসবা-আখাউড়ায় আসেন কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট আহমদ আজম খান। তিনি গ্রুপিং নিরসনে উভয় পক্ষের নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলেন।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া-১ (নাসিরনগর) : এই আসনে বিএনপি ৩টি গ্রুপে বিভক্ত। দলের মনোনয়ন পেতে দৌড়ঝাঁপ করছেন বেশ কয়েকজন। মনোনয়ন পেতে মাঠে কাজ করছেন জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও জেলা বিএনপির সদস্য অ্যাডভোকেট কামরুজ্জামান মামুন। তিনি এর আগে ১৯৯১ সালে দলের মনোনয়ন পেয়েছিলেন। কামরুজ্জামান মামুন বলেন, প্রতিদিনই এলাকায় গণসংযোগ করছি। দলের কর্মসূচি, সামাজিক অনুষ্ঠান এবং ওয়াজ মাহফিলগুলোতেও যাচ্ছি। ৩১ দফা বাস্তবায়নের জন্য আমি মাঠে-ময়দানে ঘুরে বেড়াচ্ছি।
তিনি ছাড়াও উপজেলা বিএনপির সভাপতি এমএ হান্নান, জেলা বিএনপির সদস্য শফিকুল ইসলাম মনোনয়নপ্রত্যাশী। এমএ হান্নান বলেন, দলের দুর্দিনে দলের সঙ্গে ছিলাম, বর্তমানেও আছি। ভবিষ্যতেও দলের সিদ্ধান্তের সঙ্গে আছি। এদিকে আওয়ামী লীগে যোগ দেওয়া শিল্পপতি সৈয়দ এ. কে. একরামুজ্জামান সুখন আবার বিএনপিতে ফিরতে পারেন এমন কানাঘুষাও দলে এবং এলাকার মানুষের মুখে চাউর রয়েছে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ (সরাইল-আশুগঞ্জ) : এই আসনেও বিএনপি ২টি গ্রুপে বিভক্ত। একটি হচ্ছে ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা এবং অপরটি স্থানীয় বিএনপি নেতা নুরুজ্জামান লস্কর তপুর গ্রুপ। এই আসন থেকে নির্বাচন করার ঘোষণা দিয়ে জোরেশোরে প্রচারণা চালাচ্ছেন বিএনপির সহ-আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা। তিনি প্রায় প্রতি সপ্তাহেই তার নির্বাচনি এলাকার দুটি উপজেলা সরাইল ও আশুগঞ্জে বিভিন্ন কর্মসূচিতে যোগ দিচ্ছেন। গত ২৯ নভেম্বর সরাইল উপজেলা সদরের অন্নদা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে অনুষ্ঠিত রুমিন ফারহানার জনসভায় মানুষের ঢল নামে। এই আসনে দলের মনোনয়ন পেতে আরও কাজ করছেন বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য শেখ শামীম, হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান কল্যাণ ফ্রন্টের মহাসচিব এসএন তরুণ দে, সরাইল উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট আবদুর রহমান, সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট নুরুজ্জামান লস্কর তপু, জেলা বিএনপির সদস্য আহসান উদ্দিন খান শিপন, আশুগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সভাপতি আবু আসিফ আহমেদ। যোগাযোগ করা হলে ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা বলেন, সরাইল ও আশুগঞ্জে আমার জনসভাই প্রমাণ করে এলাকায় আমার জনপ্রিয়তা কতটুকু। আগামী নির্বাচনের জন্য আমি শতভাগ প্রস্তুত আছি।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ (সদর-বিজয়নগর) : এই আসনে পাঁচবার এমপি ছিলেন বিএনপির প্রবীণ নেতা, সাবেক নৌপরিবহণ প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট হারুন আল রশিদ। বর্তমানে মাঠে রয়েছেন কেন্দ্রীয় বিএনপির অর্থনৈতিকবিষয়ক সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার খালেদ হোসেন মাহবুব শ্যামল। ২০১১ সালের উপনির্বাচনে এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপির মনোনয়ন নিয়ে প্রার্থী হয়েছিলেন তিনি। এখন সপ্তাহে অন্তত ২-৩ দিন এলাকায় নানা কর্মসূচিতে যোগ দিচ্ছেন। ইঞ্জিনিয়ার শ্যামল বলেন, জনগণের রায়ই আসল রায়। আমরা মানুষের জন্য কাজ করতে চাই। তাই আমি জনগণের দুয়ারে দুয়ারে যাচ্ছি।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৪ (কসবা-আখাউড়া) : এই আসনেও বিএনপি ২টি গ্রুপে বিভক্ত। একটি হচ্ছেন সাবেক এমপি ও বিশ্বব্যাংকের বিকল্প নির্বাহী পরিচালক মুশফিকুর রহমান, অন্যটি কবির আহমেদ ভূঁইয়ার গ্রুপ। কবির আহমেদ ভূঁইয়া দল গোছানোর কাজ করছেন। এরই মধ্যে আখাউড়া ও কসবা উপজেলা শাখার সম্মেলন হয়েছে তার নেতৃত্বে। তবে এখনো কোনো কমিটি ঘোষণা হয়নি। কবির আহমেদ ভূঁইয়া বলেন, নির্বাচনের জন্য আমি কসবা ও আখাউড়ায় কাজ করছি। আমি সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের নির্যাতনের শিকার। আমি সব সময় জনগণের পাশে ছিলাম। তিনি বলেন, দলে কোনো গ্রুপিং নেই। বিএনপি যেহেতু বড় দল এখানে প্রতিযোগিতা থাকবেই। এদিকে গত ২১ সেপ্টেম্বর সাবেক এমপি মুশফিকুর রহমান আখাউড়ায় বন্যার্তদের জন্য ত্রাণ কর্মসূচিতে অংশ নিতে এলে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে কবির গ্রুপ। তবে তাদের বাধা উপেক্ষা করে কয়েক হাজার নেতাকর্মী নিয়ে আখাউড়া ও কসবায় বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে উপহার সামগ্রী বিতরণ এবং একাধিক সভা ও পথসভায় বক্তব্য রাখেন মুশফিকুর রহমান। গত ২১ সেপ্টেম্বর তিনি নির্বাচনি এলাকার দুই উপজেলায় গণসংযোগ করেন। মুশফিকুর রহমান বলেন, ২০০১ সালে নির্বাচনে জয়ী হয়ে এলাকায় ব্যাপক উন্নয়ন করেছি।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৫ (নবীনগর) : এই আসনে বিএনপি ৩টি গ্রুপে বিভক্ত। আগামী নির্বাচনে এই আসনে ৬ জন প্রার্থী দলের মনোনয়নের আশায় মাঠে কাজ করছেন। তারা হলেন-জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সাবেক সদস্য কাজী নাজমুল হোসেন তাপস, কেন্দ্রীয় বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য মো. সায়েদুল হক সাঈদ, কেন্দ্রীয় কৃষক দল নেতা তকদীর হোসেন মো. জসিম, কেন্দ্রীয় বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জাসাসের সাবেক সভাপতি সালাহউদ্দিন ভূঁইয়া শিশির, জেলা বিএনপির আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট আবদুল মান্নান, কৃষক দল কেন্দ্রীয় কমিটির সহসাধারণ সম্পাদক কেএম মামুন অর রশিদ, ছাত্রদল কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সহসভাপতি রাজীব আহসান চৌধুরী পাপ্পু।
কাজী নাজমুল হোসেন তাপস যুগান্তরকে বলেন, নেতৃত্বের প্রতিযোগিতার জন্য গ্রুপিং থাকতে পারে। এই উপজেলার প্রায় সবগুলো ইউনিয়ন-ওয়ার্ডের কমিটি আমার বাবার হাতে গড়া। আমি মাঠে কাজ করে যাচ্ছি। বিএনপির আরেক নেতা মো. সায়েদুল হক সাঈদ গত ১৭ নভেম্বর তার নিজ ইউনিয়ন বড়াইলে এক বড় সমাবেশ করে দলের মনোনয়ন চাওয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। এরপর থেকে নানা কর্মসূচিতে সরব তিনি। অ্যাডভোকেট আবদুল মান্নান বলেন, সারা নবীনগর ঘুরেছি। জনগণের ব্যাপক সাড়া পেয়েছেন বলে জানান তিনি। কৃষক দল নেতা কেএম মামুন অর রশিদ বলেন, কৃষক দল থেকে কুমিল্লা অঞ্চলে আমিই একমাত্র মনোনয়ন প্রার্থী। নবীনগরের প্রত্যেক ইউনিয়নে কৃষকদের নিয়ে সমাবেশ করছি।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৬ (বাঞ্ছারামপুর) : এই আসনেও বিএনপি ২টি গ্রুপে বিভক্ত। সাবেক এমপি ও কেন্দ্রীয় বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য এমএ খালেক মনোনয়ন প্রার্থীদের অন্যতম। ২০০৮ ও ২০১৮ সালে দলের প্রার্থী ছিলেন তিনি। আবদুল খালেক বলেন, শতভাগ জনপ্রিয়তা রয়েছে আমার। দলের বড় বড় সমাবেশ, মিটিং-মিছিল করছি এলাকায়। তিনি ছাড়াও কেন্দ্রীয় বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য অ্যাডভোকেট রফিক সিকদার, কেন্দ্রীয় কৃষক দলের নেতা ও বাঞ্ছারামপুর বিএনপির সভাপতি কৃষিবিদ মেহেদী হাসান পলাশ মনোনয়নপ্রত্যাশী। সম্প্রতি এই উপজেলায় বিএনপির সম্মেলন নিয়ে খালেক ও মেহেদীর গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষে ৪০ জন আহত হন। এসব বিষয়ে জেলা বিএনপির সদস্য সচিব মো. সিরাজুল ইসলাম সিরাজ বলেন, অনেক বছর পর ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মাধ্যমে আমরা একটা দানবীয় ফ্যাসিস্ট শাসন থেকে মুক্তি লাভ করেছি। আমাদের নেতাকর্মীরা অনেকটাই প্রাণবন্ত। আমাদের দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশনা অনুযায়ী সবাইকে চলতে হচ্ছে। জেলার প্রতিটি আসনে একাধিক মনোনয়নপ্রত্যাশী থাকলেও এখন সবাই দল গোছাতে ব্যস্ত। তিনি আরও বলেন, বিএনপিতে দলীয় কোনো গ্রুপিং নেই। তবে নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা থাকতেই পারে।