বিয়েতে নাচগানের জন্য সালিশ, মাতবরদের সতর্ক করলেন ইউএনও
রাজশাহী ব্যুরো
প্রকাশ: ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:৩৪ পিএম
রাজশাহীর দুর্গাপুর উপজেলায় বিয়েতে নাচগান করেছিলেন বরপক্ষের আত্মীয়স্বজনরা। এ অপরাধে বর এবং তার নিকটাত্মীয়দের বিচারের জন্য আয়োজন করা হচ্ছিল গ্রাম্য সালিশের। বিষয়টি জানতে পেরে সোমবার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সাবরিনা শারমিন গ্রাম্য মাতবরদের সতর্ক করেছেন।
দুর্গাপুরের দাউকান্দি মধ্যপাড়া গ্রামের যুবক সোহানুর রহমান সোহান (২৫) গত ১৯ নভেম্বর বিয়ে করেন। আগের রাতে তার বাড়িতে সাউন্ড বক্স বাজিয়ে নাচানাচি করেন বাড়ির নারী ও কিশোরীরা। এজন্য গত ২২ নভেম্বর স্থানীয় মসজিদে জুমার নামাজ শেষে সোহান ও তার আত্মীয়স্বজনদের ধরে এক দফা ভর্ৎসনা করেন মাতবররা। পরে গ্রামের প্রভাবশালী ও মসজিদ কমিটির উপদেষ্টা পুলিশ বাহিনী থেকে অবসরপ্রাপ্ত সদস্য আবদুস সামাদ ওরফে সামাদ দারোগা এবং তার সহযোগীরা জানিয়ে দেন, গানবাজনার মতো গর্হিত কাজের জন্য আগামী ২৭ নভেম্বর সালিশ বসিয়ে বিচার করা হবে। সেখানে সোহানের পরিবারকে উপস্থিত থাকতে হবে। এতে পরিবারটি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে।
এরপর এক কান, দুই কান হতে হতে বিষয়টি প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়েও জানাজানি হয়। রোববার দুপুরে আবদুস সামাদ ওরফে সামাদ দারোগার সঙ্গে যুগান্তরের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয়।
তখন আবদুস সামাদ বলেন, গ্রামে তারা একটি ‘আইন’ করেছেন যে বিয়েশাদীর অনুষ্ঠানে কেউ গানবাজনা করতে পারবে না। সোহান এই ‘আইন’ লঙ্ঘন করেছেন। এজন্য তার বিচার হবে। সালিশ কবে আয়োজন করা হবে তা তারা সোমবার বসে দিন ঠিক করবেন।
গ্রামে এমন ‘আইন’ করা যায় কিনা জানতে চাইলে পুলিশের অবসরপ্রাপ্ত এই কর্মকর্তা বলেন, ‘এটা গ্রামের সবার সিদ্ধান্ত। সবাই যেটা চায় সেটা তো আইন হয়ে যায়।’
এদিকে রোববার রাতে ‘বিয়েতে গান বাজিয়ে শাস্তির মুখে সোহান’ শিরোনামে যুগান্তর অনলাইনে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। বিষয়টি জানাজানি হলে সোমবার উভয়পক্ষকে ডেকে পাঠান ইউএনও সাবরিনা শারমিন। তিনি গ্রাম্য মাতবর ও ভুক্তভোগী সোহানের লিখিত বক্তব্য গ্রহণ করেন।
এরপর আবদুস সামাদকে সতর্ক করে জানিয়ে দেন, এ ধরনের ‘আইন’ তিনি গ্রামে চালু করতে পারবেন না। ওই সময় দুর্গাপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) দুরুল হোদাসহ প্রশাসনের অন্য কর্মকর্তারাও ছিলেন।
ইউএনও সাবরিনা শারমিন বলেন, উচ্চশব্দের কারণে জনভোগান্তি তৈরি হলে গ্রামবাসী প্রশাসনের কাছে অভিযোগ করতে পারেন। প্রয়োজনে ভ্রাম্যমাণ আদালত ব্যবস্থা নিতে পারবে; কিন্তু গ্রামের কেউ এলাকায় কোনো বিচার-সালিশ করতে পারবেন না।
সোহান বলেন, বিয়েবাড়িতে বন্ধু-স্বজনরা একটু আনন্দ করেছেন মাত্র। দেশের অনেক জায়গায় এখনো বিয়েবাড়িতে বা ছোটখাটো অনুষ্ঠানে সবাই একটু আনন্দ করেন। আমাদের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল।
এলাকার লোকজন জানান, বিয়েশাদীর অনুষ্ঠানে গ্রামে গানবাজনা বাজে। কিশোর-কিশোরী ও বাড়ির নারীরা নাচেন। এটা বিয়েবাড়ির একটা ঐতিহ্য; কিন্তু এই গ্রামের প্রভাবশালীরা ‘আইন’ চালু করেন যে গ্রামে বিয়ের অনুষ্ঠানে কোনো গানবাজনা করা যাবে না।
গ্রামের লোকজন আরও জানান, গ্রামে কারও বাড়িতে বিয়ের আয়োজন হলে গ্রাম্য মাতবর সামাদ দারোগা ও নওশাদ আলী মাস্টারকে দাওয়াত দিতেই হয়। কেউ দাওয়াত না দিলে তারা ক্ষুব্ধ হন।
তারা আরও জানান, কিছুদিন আগেই গ্রামে বল্টু মাস্টারের বাড়িতে বিয়ের অনুষ্ঠান হয়েছে। বল্টুর ভাগ্নের বিয়ের ওই অনুষ্ঠানেও গানবাজনা হয়েছিল। ওই বিয়েতে প্রভাবশালীদের দাওয়াত করে খাওয়ানো হয়েছিল। তাই কোনো সমস্যা হয়নি কিন্তু একটি কোম্পানিতে মাত্র ৮ হাজার টাকা বেতনে চাকরি করা সোহান গ্রামের প্রভাবশালীদের দাওয়াত দিতে পারেননি। তাই গ্রাম্যসালিশ বসিয়ে তাকে অপমান-অপদস্থ করার পরিকল্পনা ছিল প্রভাবশালীদের।
আব্দুস সামাদ সম্পর্কে এলাকাবাসী জানান, তিনি পুলিশ বাহিনী থেকে অবসরে আসার পর আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে এলাকায় দাপট দেখাতেন। ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরির্বতনের পর সামাদ দারোগা এখন বিএনপিতে ভিড়েছেন। সম্প্রতি সামাদ দারোগা দাউকান্দি বাজারে এক মিষ্টির দোকানের মালিকের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন। দোকান মালিকের অপরাধ ছিল, তিনি সামাদের কাছে মিষ্টির দাম চেয়েছেন। মিষ্টি কেনার পর সামাদ দাম দেবেন না। এছাড়া এক মাছ বিক্রেতাকেও সম্প্রতি সামাদ দারোগা মারধর করেছেন। তার অত্যাচারে এলাকার মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন।
এ বিষয়ে কথা বলার জন্য সোমবার বিকালে আবদুস সামাদ ওরফে সামাদ দারোগাকে ফোন করা হয়। তিনি ফোন ধরে জানান, তিনি বাইরে থেকে অটোরিকশায় চড়ে বাড়ি ফিরছেন। গাড়ির শব্দে কথা শুনতে পাচ্ছেন না। পরে কথা বলবেন। সন্ধ্যায় আবার ফোন করা হলে তিনি রিসিভ না করে কেটে দেন। তাই এ বিষয়ে তার কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।