গারো পাহাড়ে বাড়ছে বন্যহাতি, একবছরে অর্ধশত শাবকের জন্ম

মো. আব্দুর রহিম বাদল, শেরপুর প্রতিনিধি
প্রকাশ: ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ০১:১৫ পিএম

শেরপুরের গারো পাহাড়ে দিনে দিনে বাড়ছে বন্যহাতির সংখ্যা। গত এক বছরে প্রায় অর্ধশত নতুন হাতির শাবকের জন্ম হয়েছে বলে জানিয়েছে বন বিভাগ।
এর আগে শেরপুরের গারো পাহাড়ে ১০০-১২০ টির মতো বন্যহাতির বিচরণ লক্ষ্য করা গেলেও বর্তমানে তা বেড়ে কমপক্ষে ১৭০টিতে দাঁড়িয়েছে বলে স্থানীয় বন কর্মকর্তারা ধারণা করছেন।
বনবিভাগের কর্মকর্তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, শেরপুরের গারো পাহাড় এলাকায় ক্রমেই প্রজননের মাধ্যমে বন্যহাতির বংশ বিস্তার ঘটছে। ফলে বৃদ্ধি পাচ্ছে বন্যহাতির সংখ্যা। এসব এলাকায় গত এক বছরে প্রায় অর্ধশত নতুন হাতির শাবকের জন্ম হয়েছে।
বাংলাদেশ থেকে এশিয়ান প্রজাতির বন্যহাতির সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে এবং বিলুপ্তের পথে চলে আসছে বলে হাতি গবেষকরা উদ্বেগজনক খবর জানালেও শেরপুরে আশার আলো দেখছেন বন বিভাগের কর্মকর্তারা।
শেরপুর বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ বিভাগের সদর রেঞ্জের রেঞ্জ কর্মকর্তা মঞ্জুরুল আলম বলেন, শেরপুরে হাতির সংখ্যা বাড়ছে এটা নিঃসন্দেহে সঠিক তথ্য। এখানে প্রতিটি দলেই বিভিন্ন বয়সের হাতির বাচ্চা দেখা যাচ্ছে। গত দু’দিন আগে আমাদের ড্রোন ক্যামেরায় বনের ভিতর ৩৪ সদস্যের একটি হাতির দলে ৮ থেকে ১০টি বাচ্চা দেখা গেছে। অর্থাৎ ২৪টি হাতির সঙ্গে ১০ টি হাতির বাচ্চা। এটি খুবই আশার কথা।
তিনি বলছেন, আমাদের এই অঞ্চলে হাতির আবাসস্থল বৃদ্ধি এবং খাদ্য সংকট কমে আসার কারণেই দিন দিন হাতের সংখ্যা বাড়ছে বলে আমরা মনে করি। যদিও চার বছর অন্তর হাতি শাবক প্রসব করে।
তিনি আরও বলেন, হাতি রক্ষায় আমরা ২০১৪ সাল থেকেই শেরপুরের তিনটি রেঞ্জ এলাকায় ৫০০ হেক্টর জমিতে হাতির খাদ্য বান্ধব গাছ রোপণ করেছি।
বনবিভাগের শেরপুরের শ্রীবরদী উপজেলার বালিজুরি রেঞ্জ কর্মকর্তা সুমন মিয়া বলেন, সর্বশেষ ২২ নভেম্বর বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে শেরপুরের শ্রীবরদী উপজেলার বালিজুরি রেঞ্জ অফিসের পেছনের জঙ্গলে একটি হাতি শাবকের জন্ম হয়। এর দুই তিন মাস আগেও এই জঙ্গলে আরও কয়েকটি হাতি শাবকের জন্ম হয়েছে।
এই কর্মকর্তা বলেন, বালিজুরি রেঞ্জে বেশ কিছু এলাকায় গভীর বন থাকায় এখানে প্রায় তিনটি দলে বিভক্ত হয়ে হাতির দল বিচরণ করে আসছে। এই তিনটি দলে ৩০ থেকে ৩৫টি করে হাতি রয়েছে। সেই সঙ্গে প্রতিটি দলে ৭ থেকে ৮টি হাতি শাবক দেখা যায়। বৃহস্পতিবার রাতে বালিজুরি রেঞ্জ অফিসের পাশেই জন্ম নেওয়া হাতি শাবক এখন সুস্থ আছে এবং দলবদ্ধ হয়ে মা হাতির সঙ্গে বনের ভেতরে ঘোরাফেরা করতে দেখা গেছে।
এদিকে শেরপুরের সীমান্তবর্তী শ্রীবরদী, ঝিনাইগাতী ও নালিতাবাড়ী উপজেলার গারো পাহাড় এলাকায় প্রায়ই বন্যহাতির আক্রমণের শিকার হচ্ছে স্থানীয়রা। এসব আক্রমণে যেমন মানুষ মারা যাওয়ার ঘটনা আছে, তেমনই মানুষের হাতে বন্যহাতির মৃত্যুর ঘটনাও।
এছাড়া বন্যহাতির তাণ্ডবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে খেতের ফসল তছনছ হচ্ছে ঘরবাড়ি ও গাছপালা। এসব পুরোনো খবরের মাঝে বর্তমানে চমকপ্রদ এবং আশা জাগানিয়া হাতির সংখ্যা বৃদ্ধির এই নতুন খবর জানিয়েছে শেরপুর বন বিভাগ।
সর্বশেষ ২০১৪ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ময়মনসিংহ অঞ্চলের বন্যহাতি সংরক্ষণ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, শেরপুর ও জামালপুর জেলার গারো পাহাড় এলাকায় হাতির আক্রমণে মানুষ মারা পড়েছে ৪৩ জন। এর মধ্যে ময়মনসিংহ জেলায় ১০ জন, জামালপুর জেলায় ৩ জন, নেত্রকোনা জেলায় ৫ জন এবং শেরপুর জেলায় সর্বোচ্চ ২৫ জন।
অপরদিকে মানুষের হাতে নানাভাবে হাতি মারা পড়েছে জামালপুর জেলায় ৩টি, নেত্রকোনা জেলায় ২টি এবং সর্বোচ্চ শেরপুর জেলায় ২৭ টি হাতি। মানুষ মারা গেলে সরকার থেকে বন বিভাগের মাধ্যমে আর্থিক ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়। কিন্তু হাতি মারা গেলে বা হত্যা করা হলে এতদিন কোনো আইনি ব্যবস্থাপন করা হয়নি।
তবে সর্বশেষ ২০২১ সালের ১২ নভেম্বর শ্রীবরদী উপজেলায় এবং চলতি বছরের ১ নভেম্বর নালিতাবাড়ী উপজেলায় মাত্র দু’টি হাতি হত্যার অভিযোগে বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন অনুযায়ী পৃথক দু’টি মামলা হয়েছে।
এ বিষয়ে বালিজুরি রেঞ্জ কর্মকর্তা সুমন মিয়া বলেন, সম্প্রতি আমাদের বন বিভাগ এবং স্থানীয় প্রশাসনের যৌথ সভায় হাতি রক্ষায় এবং জানমালের ক্ষতি রক্ষায় বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। এসব সিদ্ধান্তের কারণে হাতির ওপর আক্রমণ থেকে বিরত থাকছেন সাধারণ মানুষ। সেইসঙ্গে তাদের খেতের ফসল বাঁচাতেও হাতির ওপর হামলা না চালিয়ে বিভিন্ন কৌশলে হাতিকে তাড়ানোর জন্য বন বিভাগের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে।
শেরপুরের পরিবেশবাদী যুব সংগঠন গ্রিন ভয়েসের সভাপতি কবি ও সাংবাদিক রফিক মজিদ জানান, বিলুপ্তপ্রায় এই এশিয়ান প্রজাতির হাতির সংখ্যা বাড়ছে এটি খুবই আশার কথা। তবে আগামী দিনগুলোতে জানমালের রক্ষার পাশাপাশি হাতি রক্ষা করতে স্থানীয় জনগণ এবং প্রশাসনের সুদৃষ্টি রাখা প্রয়োজন বলে আমরা মনে করি।