আওয়ামী সিন্ডিকেট চালের বাজারে, সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে সক্রিয় হানিফ আস্থাভাজনরা

এএম জুবায়েদ রিপন, কুষ্টিয়া
প্রকাশ: ১৯ নভেম্বর ২০২৪, ১২:৪৫ পিএম

বাজারে উঠেছে আমনের নতুন ধান, উৎপাদনও ভরপুর। কৃষক পর্যায়ে কমেছে ধানের দাম। ১০ দিনের মধ্যে ধানের দাম প্রতি মনে কমেছে ৫০ থেকে ৮০ টাকা পর্যন্ত। তারপরও দেশে চালের বাজারে বিরাজ করছে চরম অস্থিরতা। পর্দার আড়ালে বাজারে খেলছে অন্য কোনো শক্তি। ফলে বিফলে যাচ্ছে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সব উদ্যোগ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চালের বাজার অস্থিরতার পেছনে রয়েছে আওয়ামীপন্থি মিল মালিকরা। দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তর চালের মোকাম কুষ্টিয়ার খাজানগরে আওয়ামীপন্থি আট মিল মালিকের শক্তিশালী সিন্ডিকেট কাজ করছে। দলীয় পদ-পদবিসহ আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফের চরম আস্থাভাজন হিসাবে পরিচিত তারা। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ব্যবসার বাইরেও জেলাজুড়ে রাজত্ব করেছে এসব মিল মালিকরা। বর্তমানেও এখানে ধান-চালের নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতেই। মূলত নানা অজুহাতে এরাই বাড়াচ্ছেন চালের দাম। একাধিক সূত্র বলছে, চালের বাজার অস্থিতিশীল করে তুলে সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে কাজ করছেন হানিফের আস্থাভাজন হিসাবে পরিচিত এসব মিল মালিকরা।
কুষ্টিয়ার সিনিয়র কৃষি বিপণন কর্মকর্তা সুজাত হোসেন খান সিন্ডিকেটের বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, খাজানগরের কয়েকটি মিলে বিপুল পরিমাণ ধান-চাল মজুত রয়েছে। এই কর্মকর্তা মনে করেন, ছোটখাটো অভিযান চালিয়ে কোনোভাবেই সিন্ডিকেট ভাঙা সম্ভব না। সিন্ডিকেট ভাঙতে হলে বড় ধরনের অভিযান চালাতে হবে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তর চালের মোকাম কুষ্টিয়ার খাজানগরে রয়েছে অর্ধশত অটো রাইস মিল। রাজধানী ঢাকার বাজারে যে মিনিকেট চাল আসে, তার বড় অংশ আসে কুষ্টিয়ার ৩১ স্বয়ংক্রিয় বা অটো রাইস মিল থেকে। এখানে এত অটো মিল থাকলেও মূলত ১১ মালিকের হাতে পুরো খাজানগরের নিয়ন্ত্রণ। যারমধ্যে আটজন সরাসরি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। খাজানগরের সব মিলে যে পরিমাণ চাল উৎপাদন হয়, তার সমপরিমাণ চাল উৎপাদন করে থাকেন ১১ মিল মালিক এবং প্রায় ৬০ শতাংশ ধান-চাল মজুতও থাকে তাদের গুদামে। সাধারণ মিল মালিকদের অভিযোগ, বড় বড় মিল মালিকদের কলকাঠিতে বাজারে চালের বাজারে বিরাজ করছে চরম অস্থিরতা।
সূত্রে জানা যায়, খাজানগরে ধান-চালের রাজত্ব করেন রশিদ এগ্রো ফুড প্রোডাক্টস লিমিটেডের আব্দুর রশিদ, সুবর্ণা রাইস মিলের জিন্নাহ, দেশ এগ্রো ফুডের আব্দুল খালেক, স্বর্ণা রাইস মিলের আব্দুস সামাদ, গোল্ডেন রাইস মিলের জিকু, জাফর এগ্রো ফুডের আবু জাফর, ফ্রেস এগ্রো ফুডের ওমর ফারুক, দাদা রাইস মিলের আরশেদ আলী, প্রগতি রাইস মিলের হযরত আলী, ফোর স্টার রাইস মিলের মফিজ উদ্দিন ও ব্যাপারী রাইস মিলের তোফাজ্জেল ব্যাপারী। এসব মিল মালিকের মধ্যে আটজনই আওয়ামী পরিবারের। তারমধ্যে চারজন সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয়, রয়েছে পদ-পদবি। এরা হলেন কুষ্টিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের কোষাধাক্ষ্য ও ফ্রেস এগ্রো ফুডের মালিক ওমর ফারুক, কুষ্টিয়া শহর আওয়ামী লীগের এক নম্বর ওয়ার্ডের সাধারণ সম্পাদক ও জাফর এগ্রো ফুডের মালিক আবু জাফর, কুষ্টিয়া সদর উপজেলার বটতৈল ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও ফোর স্টার রাইস মিলের মালিক মফিজ উদ্দিন ও সুবর্ণা রাইস মিলের মালিক জিন্নাহর ছেলে রাজীব আহম্মেদ নিষিদ্ধ ঘোষিত জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি। বাকি চারজন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফের খুব কাছের আস্থাভাজন হিসাবে পরিচিত। এরমধ্যে দেশের চাল সিন্ডিকেটের মূলহোতা এবং যার ইশারায় দেশে চালের দাম উঠানামা করত সেই আব্দুর রশিদও ছিলেন মাহবুবউল আলম হানিফের অত্যন্ত আস্থাভাজন। আব্দুর রশিদের ভাই সিদ্দিকুর রহমান ছিলেন কুষ্টিয়া জেলা বিএনপির কোষাধ্যক্ষ। মাহবুবউল আলম হানিফের সঙ্গে সুসম্পর্কের সূত্র ধরেই ২০১৭ সালে ভাই বিএনপি নেতা সিদ্দিকুরকে নিয়ে আওয়ামী লীগে যোগ দেন আব্দুর রশিদ। আওয়ামী লীগ আমলে মাহবুবউল আলম হানিফকে ব্যবহার করে সবচেয়ে সুবিধা নিয়েছেন দেশ এগ্রো ফুডের আব্দুল খালেক ও প্রগতি রাইস মিলের হযরত আলী। নেতার প্রভাবে জেলা খাদ্য অফিসের নিয়ন্ত্রণও ছিল তাদের হাতে। হানিফের সঙ্গে পারিবারিক সম্পর্ক ছিল দেশ এগ্রো ফুডের আব্দুল খালেকের। দুজনের বাড়িতে দুজনের নিয়মিত ছিল যাতায়াত। হানিফকে ব্যবহার করে প্রতিপক্ষ অনেককে ঘায়েল করেছেন খালেক। এছাড়া দাদা রাইস মিলের আরশেদ আলীও আওয়ামী লীগপন্থি হিসাবে পরিচিত। হানিফ ও তার ভাই আতার আস্থাভাজন হিসাবে পরিচিত আরশেদ।
সুবর্ণা রাইস মিলের মালিক জিন্নাহর দুই ছেলেই নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। বড় ছেলে রাজীব আহমেদ কুষ্টিয়া জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সভাপতি। ওই এলাকার শান্তির মোড়ে সুবর্ণা রাইস মিলের প্রধান কার্যালয়। ওই কার্যালয়ে দ্বিতীয় তলায় অভিজাত একটি কক্ষ রয়েছে। ওই কক্ষের জন্য ৫ লাখ টাকা দিয়ে দুটি কাঠের চেয়ার তৈরি করেছেন জিন্নাহ। সেই চেয়ার দুটি সংরক্ষিত ছিল শুধু আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ ও তার ভাই সাবেক উপজেলার চেয়ারম্যান আতাউর রহমানের জন্য। আর ফ্রেস এগ্রোর মালিক ওমর ফারুক ছিলেন হানিফের ভাই আওয়ামী আমলে কুষ্টিয়ার নিয়ন্ত্রক সাবেক উপজেলার চেয়ারম্যান আতাউর রহমান আতার সব অপকর্মের সহযোগী। কোনোদিন দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত না থাকলেও আতার আস্থাভাজন হিসাবে রাতারাতি হয়ে যান কুষ্টিয়া সদর থানা আওয়ামী লীগের কোষাধাক্ষ্য। ব্যবসায়ীরা জানান, জুলাই-আগস্টে ছাত্র আন্দোলনের পর বেড়ে যায় চালের দাম। এরপর আর স্বস্তি ফেরেনি বাজারে। আরেক দফা বেড়েছে দাম। মজুত নিয়মের ধার না ধরে হাজারও টন ধান-চাল গুদামে ভরে রেখেছেন আওয়ামী লীগপন্থি এসব মিলাররা। দেশে ধান-চালের সংকটতো দূরের কথা, বাজারে নতুন ধান এলেও চালের বাজারে অরাজকতা চলছেই।
দেশ এগ্রো ফুডের মালিক আব্দুল খালেক সিন্ডিকেটের কথা স্বীকার করে বলেন, দেশের চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে ১০টি করপোরেট কোম্পানি। তাদের নিয়ন্ত্রণ করা গেলে চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। রাজনৈতিকভাবে এখানে কোনো সিন্ডিকেট নেই বলেও জানান আব্দুল খালেক। কুষ্টিয়া অটো মিল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জয়নাল আবেদিন প্রধান বলেন, কয়েকদিন হলো নতুন ধান উঠতে শুরু করেছে। এ পর্যন্ত কৃষক পর্যায়ে ৪০ শতাংশ ধান কাটা পড়েছে। বাকি ধান উঠলে চালের বাজার কমে যাবে।
কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসক মো. তৌফিকুর রহমান বলেন, মিল মালিকদের কঠোর নজরদারিতে রাখা হয়েছে। এখানে কোনো সিন্ডিকেট হতে দেওয়া হবে না। নিয়মিত মিল মালিকদের সঙ্গে আলোচনা হচ্ছে। তারা বলেছেন, বাজারে নতুন ধান উঠলে চালের বাজার কমে যাবে।