
প্রিন্ট: ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:২৬ এএম
চাকরিতে যোগ দিয়েই কয়েক কোটি টাকার মালিক অনুপ

হোসাইন আহমদ, মৌলভীবাজার
প্রকাশ: ১৮ নভেম্বর ২০২৪, ১০:৫২ পিএম

মৌলভীবাজারের রাজনগর উপজেলা পরিষদের তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী সাঁট মুদ্রাক্ষরিক কাম কম্পিউটার অপারেটর (সিএ) অনুপ চন্দ্র দাশ চাকরিতে যোগদান করেই আলাদিনের চেরাগের সন্ধান পান। অল্প দিনের মধ্যেই আঙুল ফুলে কলাগাছে পরিণত হয়েছেন। মালিক হয়েছেন কয়েক কোটি টাকার।
শ্রীমঙ্গলের অভিজাত এলাকায় করেছেন ডুপ্লেক্স বাড়ি। অফিসে রাতে বসাতেন মদের আসর। দিনে-দুপুরে অফিসে বসে পান করতেন সিগারেট। ঘুসের বিনিময়ে বণ্টন করতেন সরকারি বরাদ্দ। গভীর নলকূপ প্রদানেও করেছেন ঘুস আদায়।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তার আধিপত্যে কেউই সাহস করে অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রতিবাদ করতে পারতেন না। সাধারণ সেবা গ্রহীতা এবং কর্মকর্তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করতেন। শ্রীমঙ্গলে ক্ষুদ্র ঋণের ব্যবসার সঙ্গেও জড়িত ছিলেন ওই কর্মচারী।
যুগান্তরের অনুসন্ধানে এমন চিত্র উঠে এসেছে।
জানা যায়, ২০১২ সালের সেপ্টেম্বরে চাকরি স্থায়ী হয় অনুপ চন্দ্র দাসের। এরপর থেকেই তিনি বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। তৎকালীন উপজেলা চেয়ারম্যান ছিলেন প্রয়াত মিছবাহুদ্দোজা ভেলাই। অনুপ মিছবাহুদ্দোজার ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে যাবতীয় কাজ করতেন।
এক পর্যায়ে ২০১৪ সালের নির্বাচনে মিছবাহুদ্দোজা ভেলাইকে পরাজিত করে উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন আছকির খান। আছকির খান অনুপের দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেননি। এ নিয়ে শুরু হয় দ্বন্দ্ব। এক পর্যায়ে উপজেলা পরিষদ কর্মচারী বিধিমালা-২০১০ অনুযায়ী অনুপের বেতন ভাতা ১ বছরের বেশি সময় বন্ধ রাখা হয়। পরবর্তীতে অনুপ হাইকোর্টে রিট করে বেতন চালু করেন।
২০১৯ সালে উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন শাহজাহান খান। শাহজাহান খানের হাত ধরেই ফের বেপরোয়া হয়ে ওঠেন অনুপ। ২০২৪ সালের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে শাহজাহান খানের কর্মী হিসেবে যাবতীয় নির্বাচনি কাজ করেন অনুপ।
অনুসন্ধানে জানা যায়, শ্রীমঙ্গলের সবুজভাগ (পেশকার বাড়ি) এলাকায় জায়গা কিনে অত্যাধুনিক ডিজাইনের ডুপ্লেক্স একটি বাড়ি করেছেন অনুপ। বাড়িতে ২ কোটি টাকার বেশি খরচ করেছেন। ইন্টেরিয়র ডিজাইনেই খরচ করেছেন ২৭ লাখ টাকা। বাসায় রয়েছে এসিসহ অত্যাধুনিক সব সুবিধা। শ্রীমঙ্গলে চড়া সুদে নিরীহ মানুষকে কিস্তিতেও দিতেন ক্ষুদ্র ঋণ।
সরকারি টিআর কাবিখা, এডিপি, গভীর নলকূপসহ অন্যান্য বরাদ্দে সাধারণ নাগরিকের কাছ থেকে ঘুস আদায় করতেন অনুপ।
উপজেলার সুরিখাল গ্রামের জিলাউর রহমান ও তার এক প্রতিবেশীকে গভীর নলকূপ দেওয়ার কথা বলে ২০২৩ সালের আগস্টে ৪০ হাজার টাকা ঘুস নেন অনুপ চন্দ্র দাশ। বার বার নলকূপের তাগাদা দেওয়ার পরও তিনি দিতে পারেননি। এক পর্যায়ে প্রতিবেশীর ২০ হাজার টাকা ফেরত দেন।
অভিযোগকারী জিলাউর রহমান টাকা না পেয়ে ২৮ আগস্ট জেলা প্রশাসক বরাবর লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন। জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে এ অভিযোগের তদন্ত চলছে।
অভিযোগকারী জিলাউর রহমান বলেন, টাকা আদায়ের জন্য প্রথমে রাজনগর উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কাছে অভিযোগ দেওয়ার পর টাকা দিচ্ছি দিমু বলে কয়েকবার তারিখ করেন। কিন্তু টাকা দেননি। পরবর্তীতে জেলা প্রশাসক বরাবর অভিযোগ দায়ের করেছি।
এদিকে উপজেলা পরিষদে মালি পদে নিয়োগ দেওয়া হয় সুজন মিয়াকে। উপজেলা পরিষদের সরকারি নিয়োগকৃত গাড়িচালক নির্বাহী কর্মকর্তার গাড়ি চালানোর কারণে সুজন মিয়া উপজেলা চেয়ারম্যানের সরকারি গাড়ি চালাতেন। বিগত ৫ আগস্টের পর থেকে চেয়ারম্যান না থাকায় কাজ না করেও বেতন তুলছেন সুজন মিয়া।
সূত্র বলছে, সুজন মিয়ার বেতনের একটি অংশ নেন অনুপ। অনুপ চন্দ্র দাশের শ্বশুর দিগেন্দ্র চন্দ্র সরকার রাজনগর উপজেলার উত্তরভাগ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান থাকায় অনুপ প্রভাব খাটাতেন। উপজেলা থেকে শ্বশুরকেও দিতেন নানা সুবিধা। এ নিয়েও বিতর্ক রয়েছে সর্বমহলে।
একাধিক ইউপি সদস্য বলেন, অফিসে গেলে অনুপের সঙ্গে কথা বলাই যেত না। আমাদের সঙ্গে তুই তোকারি করে কথা বলতেন। বিভিন্ন প্রকল্প নিজের পছন্দের লোক দিয়ে কমিটি করে নামকাওয়াস্তে কাজ করাতেন। উপজেলা পরিষদকে দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত করেছিলেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাজনগর উপজেলা প্রশাসনের এক কর্মচারী বলেন, বিগত পহেলা বৈশাখের রাতে অফিসে মদের আসর বসিয়েছিলেন অনুপ। মদপানের জন্য আমাকেও আমন্ত্রণ করেন।
রাজনগর উপজেলা পরিষদের সিএ অনুপ চন্দ্র দাশ বলেন, নলকূপের অভিযোগকারী দুইটা নলকূপের সরকারি ফি বাবত ২০ হাজার টাকা উপজেলা চেয়ারম্যান শাহজাহান খানের কাছে জমা দিলে উপজেলা চেয়ারম্যান আমাকে এ টাকা রাখতে বলেন। তাদের কাছ থেকে আমি ঘুস নেইনি।
ডুপ্লেক্স বাড়ির বিষয়ে তিনি বলেন, বাসায় ইন্টেরিয়র ডিজাইন যে কেউ করতেই পারে। তবে ব্যাংক লোন নিয়ে আমি বাড়ি তৈরি করেছি। শ্রীমঙ্গলে কিস্তি ব্যবসার সঙ্গে আমার কোনো সম্পৃক্ততা নেই। একটি চক্র আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ তুলছে।
রাজনগর উপজেলা নির্বাহী অফিসার সুপ্রভাত চাকমা বলেন, নলকূপের অভিযোগের বিষয়টা জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে তদন্ত করা হচ্ছে। তবে এ রকম কোনো অনিয়ম দুর্নীতির সত্যতা পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।