বদলে যাচ্ছে করতোয়ার গতিপথ, তীব্র হচ্ছে ভাঙন
মাহবুব রহমান, রংপুর
প্রকাশ: ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ১১:০০ এএম
রংপুরের পীরগঞ্জে করতোয়া নদী থেকে অবৈধভাবে প্রতিদিন শতাধিক ট্রাক বালু উত্তোলন করছে একটি চক্র। প্রশাসনের উদাসীনতার কারণে চক্রটি বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের ছত্রছায়ায় বালু উত্তোলন করে তা প্রকাশ্যে বিক্রি করা হচ্ছে। ফলে ভাঙছে নদীর পারে অবস্থিত বাড়িঘর ও ফসলি জমি। বদলে যাচ্ছে নদীর গতিপথ।
অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলনের ফলে করতোয়া নদীর ভাঙন তীব্র আকার ধারণ করেছে। শুধু তাই নয়, নদীর গতিপথেরও পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে। ভেঙে যাচ্ছে তিন ফসলি জমি, বাড়িঘরসহ বনজসম্পদ। স্থানীয়দের অভিযোগ, ৫ আগস্টের আগে কিছু কিছু অভিযান চালাত প্রশাসন। তখন বালু উত্তোলন কিছুদিন বন্ধ থাকত। কিন্তু এরপর প্রশাসনের উদ্যোগহীনতা ও স্থবিরতার কারণে প্রশাসনিক তৎপরতা বন্ধ হয়ে গেছে। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনকারী চক্রটি আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।
স্থানীয় বাসিন্দা আফজাল শেখ বলেন, করতোয়া নদী থেকে বালু উত্তোলন ও লুটের কারণে পীরগঞ্জ উপজেলার টুকুরিয়া, বড় আলমপুর, চতরা ইউনিয়নসহ পার্শ্ববর্তী নবাবগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন স্থানে নদীর গতিপথ পরিবর্তন হয়েছে। ফসলি জমিসহ বাড়িঘর ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ভাঙনের কবলে পড়েছে। জীববৈচিত্র্যের ওপর প্রভাব দেখা দিয়েছে। সরেজমিন রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার করতোয়া নদী ঘুরে দেখা যায়, নদীর ৯টি স্থানে ড্রেজার ও শ্যালো মেশিন বসিয়ে পাইপ দিয়ে টানা হচ্ছে বালু। এসব বালু ট্রাক্টর, ট্রাক, পিআপসহ বিভিন্নভাবে পীরগঞ্জ, নবাবগঞ্জ, ভাদুরিয়া, ঘোড়াঘাটসহ বিভিন্ন স্থানে যাচ্ছে। স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি সিন্ডিকেট করে এই বালু লুটের সঙ্গে জড়িত বলে জানা গেছে। এতে চতরা, বড় আলমপুর ও টুকুরিয়া ইউনিয়নের গ্রামীণ সড়কগুলোতে গভীর গর্ত সৃষ্টি হওয়ায় সেগুলো চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে উপজেলার ড. এমএ ওয়াজেদ মিয়া সেতুর উত্তর পাশে সাজেদুল ইসলাম ও তার পাশেই কাচদহ ঘাটে মুক্তার মিয়া মেশিন দিয়ে বালু তুলছেন রাতদিন। বিভিন্ন যান্ত্রিক পরিবহণযোগে এগুলো পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে নির্মাণ কাজের স্থানে।
সেতুর দক্ষিণ পাশে সুজারকুটি করতোয়া নদীতে আনোয়ার মিয়া, আমিনুল ইসলাম এবং কিনা মিয়া ৩টি শ্যালো মেশিন বসিয়ে বালুর ব্যবসা করে আসছেন প্রায় এক বছর ধরে।
এদিকে খালাশপীর বাজার থেকে ২ কিলোমিটার দক্ষিণে বাশপুকুরিয়ায় বড় ড্রেজার দিয়ে ৫০ জনের একটি সিন্ডিকেট বালু উত্তোলন করছে। করতোয়ার দিনাজপুর অংশ থেকে প্রায় ২ কিলোমিটার দূরে পাইপ দিয়ে নদী থেকে বালু টানা হচ্ছে। ওই পয়েন্টে মোটা বালুর চাহিদা প্রচুর। একটি ভেকু দিনরাত ট্রাকে বালু লোডের কাজে ব্যস্ত থাকে। এখান থেকে প্রতিদিন শতাধিক গাড়িতে করে উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় বালু পাঠানো হয়।
পত্নীর বাজার থেকে ৩ কিলোমিটার পশ্চিমে রামনাথপুর করতোয়া নদীর বানুর ঘাটেও শ্যালো মেশিন দিয়ে বিপ্লব মিয়াসহ গ্রামের অপর একটি চক্র বালু উত্তোলন করে আসছে। গড়ের বাজার থেকে পশ্চিমে হোসেনপুর হয়ে ২ কিলোমিটার দূরে করতোয়া নদীর কুলানন্দপুর ঘাট। সেখানে দিনাজপুর জেলার ঘোড়াঘাট উপজেলার কুলানন্দপুর গ্রামের শামীম মিয়াসহ পীরগঞ্জের হোসেনপুর গ্রামের প্রায় ১৪ জন পার্টনার রয়েছে এই ব্যবসার। অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রতিটি গাড়ি থেকে ৭শ টাকা পান তারা।
অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলনের ফলে নদীতে গভীর খাদ ও গর্ত সৃষ্টি হওয়ায় নদীতে ডুবে প্রাণহানির ঘটনাও ঘটছে। এক সপ্তাহ আগে কুলানন্দপুর গ্রামে নদীতে গোসল করতে গিয়ে নিখোঁজ হন অজ্ঞাত এক ব্যক্তি। পরে দিনাজপুর ফায়ার সার্ভিস তার লাশ উদ্ধার করে।
চতরা ইউনিয়ন পরিষদ থেকে পশ্চিমে ৫ কিলোমিটার দূরে কুয়াতপুর হামিদপুর বিহারিপাড়া। বর্তমান ইউপি সদস্য নূর মোহাম্মদ গোল্লাসহ কমপক্ষে ১৫ জন সদস্য তৎপর বিহারিপাড়া বালুর পয়েন্টে। করতোয়া নদীশাসন ব্যবস্থার জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ড ব্লকের কাজ করছে অথচ ব্লকের পাশ থেকে দিনরাত বালু তোলা হচ্ছে। আবার সেই বালু দিয়ে ঠিকাদার ব্লক তৈরি করে সরবরাহ করছে।
জানতে চাইলে পীরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার খাদিজা বেগম বলেন, উপজেলার অনেক এলাকায় অভিযান চলছে। অতি শিগগিরই বালুর পয়েন্টগুলোতেও মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হবে।