দল থেকে বহিষ্কারের পরও একই ভাবে চালিয়ে যাচ্ছেন দখল সন্ত্রাস চাঁদাবাজি
আকতার ফারুক শাহিন, বরিশাল
প্রকাশ: ১২ নভেম্বর ২০২৪, ১০:১৩ এএম
বরিশালের গৌরনদী-আগৈলঝাড়ার দখল সন্ত্রাস থামছে না। এর মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা গৌরনদীর। দখল হয়ে গেছে বাস স্ট্যান্ডের সব টিকিট কাউন্টার। ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে কেবল নেটওয়ার্কের (ডিশ) ব্যবসা। ওয়াইফাই ইন্টারনেট ব্যবসা থেকেও হটানো হয়েছে মালিকদের। উপজেলা পর্যায়ে থাকা সব সরকারি দপ্তর নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি নগদ আয়ের প্রায় সব সেক্টরও একে একে দখল করছেন স্থানীয় বিএনপির কয়েকজন নেতা। সেই সঙ্গে চলছে বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টার, ক্লিনিকসহ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে চাঁদা আদায়। অভিযুক্তরা অবশ্য এসব স্বীকার করছেন না।
তাদের দাবি, ১৬ বছর আগে আওয়ামী লীগ নেতাদের দখল করে নেওয়া ব্যবসাগুলো একে একে বুঝে নিচ্ছেন। পরিচয় না প্রকাশের শর্তে উপজেলা বিএনপির কয়েকজন নেতা বলেন, ‘সরকারবিরোধী আন্দোলনে গা বাঁচিয়ে চলারাই মূলত করছেন এসব। আওয়ামী লীগ আমলে ফ্যাসিস্ট সরকারের নেতাদের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে চলা নেতারাও আছেন এই তালিকায়।’
শুরুতেই পদক্ষেপ বিএনপির, বহিষ্কার ৪
৫ আগস্টের পর থেকেই গৌরনদী-আগৈলঝাড়ায় শুরু হয় দখল চাঁদাবাজি। পালিয়ে যাওয়া আওয়ামী লীগ নেতাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দখল করে বিএনপির কয়েকজন নেতা। শুরু হয় বিভিন্ন সেক্টর থেকে মোটা অঙ্কের চাঁদা আদায়। এরই মধ্যে গৌরনদী পৌর বিএনপির আহ্বায়ক এসএম জাকির শরীফ, সদস্য নাজমুল হাসান মিঠু, ফরহাদ শরীফ এবং এসএম সজীব শরিফের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির মামলা করেন টরকী বন্দরের ব্যবসায়ী জামিল শিকদার। তাদের আটক করে পুলিশে দেয় সেনা সদস্যরা। অভিযোগের সত্যতা মিললে বিএনপি থেকে বহিষ্কার করা হয় জাকিরসহ ৩ জনকে। এ ছাড়া চাঁদাবাজি সন্ত্রাসে যুক্ত থাকায় বহিষ্কার হয় আগৈলঝাড়া উপজেলা ছাত্রদলের আহ্বায়ক হামিদুল ইসলাম মহিদুল। দাবি করা চাঁদার টাকা না পেয়ে উজ্জল কুমার রাহা নামে এক ব্যবসায়ীকে আটকে রেখে মারধর ও টাকা ছিনিয়ে নেওয়ার পর তার বিরুদ্ধে ওই ব্যবস্থা নেয় দল। চাঁদাবাজি মারধরের ঘটনায় আগৈলঝাড়ার আরও এক যুবদল নেতার বিরুদ্ধে চলছে জেলা যুবদলের তদন্ত। এত সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ার পরও অবশ্য নিয়ন্ত্রণে আসছে না কিছুই। চলছে দখল সন্ত্রাস আর চাঁদাবাজি।
বেপরোয়া মুকুল খাঁ
বরিশাল (উত্তর) জেলা বিএনপির সদস্য সচিব মিজানুর রহমান মুকুল। গৌরনদীর বাসিন্দা এই নেতাকে মুকুল খাঁ নামে চেনে সবাই। তাকে আওয়ামীবিরোধী আন্দোলনে কখনোই দেখা যায়নি গৌরনদীতে। এখন উপজেলাবাসীর আতঙ্ক। পৌর বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক শাহ আলম ফকির বলেন, ‘৫ আগস্টের ১৫ দিন পর গৌরনদী আসেন মুকুল খাঁ। এসেই নিজেকে সভাপতি ও কামরুজ্জামান খোকনকে সাধারণ সম্পাদক করে ঘোষণা করেন বন্দর দোকান মালিক সমিতির কমিটি। অথচ তাদের কারোরই কোনো দোকান বা ব্যবসা নেই বন্দরে। এ নিয়ে ক্ষোভের সৃষ্টি হলে দোকান মালিকরা জোট বেঁধে পালটা কমিটি করে। তারপরও বন্দর নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছেন মুকুল।’
বন্দরের ব্যবসায়ী রিপন হাওলাদার বলেন, ‘আমরা ৯ জন মিলে ১৮-১৯ বছর আগে ওয়াইফাই ইন্টারনেটের ব্যবসা শুরু করি। কয়েক কোটি টাকা বিনিয়োগ আমাদের। ২০ আগস্টের পর সেই ব্যবসা দখল করে নেন মুকুল খাঁ। বর্তমানে লিটন ফকির নামে একজন মালিক ছাড়া আর কেউ যেতে পারছি না সেখানে। ৫০ জনের বেশি সাব এজেন্ট ছিল। তাদের প্রায় সবাইকে সরিয়ে মোটা টাকার বিনিময়ে নতুন সাব এজেন্ট নিয়োগ দিয়েছে সে।’
লিটন ফকিরের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনিও স্বীকার করেন অন্য মালিকদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে যেতে না পারার বিষয়টি। তবে মুকুল খাঁ বিষয়ে কিছু বলতে রাজি হননি তিনি।’
বন্দর দোকান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক বিশ্ব কুন্ডু বলেন, ‘আজ থেকে ১৮-২০ বছর আগে আমরা ৯ জন মিলে শুরু করি ডিশ’র (কেবল নেটওয়ার্ক) ব্যবসা। কোটি টাকা বিনিয়োগ আমাদের। আগস্টের শেষের দিকে আমাদের কাছ থেকে জোর করে সব ছিনিয়ে নেন মুকুল। ৯ মালিকের একজন স্বপন বণিককে সঙ্গে নিয়ে সাব এজেন্টদের সরিয়ে লাখ লাখ টাকার বিনিময়ে বিক্রি করছেন এজেন্সিশিপ।’
বহু মানুষের অংশীদারত্ব নিয়ে চলা গৌরনদীর বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান ‘সমবায় শ্রমিক বিড়ি’র সাবেক সাধারণ সম্পাদক লালন ফকির বলেন, ‘১৫/২০ কোটি টাকার প্রতিষ্ঠান এটি। হঠাৎ এসে আমাদের বের করে দিয়ে তা দখলে নিয়েছেন মুকুল খাঁ। চালাচ্ছেন নিজের ৩-৪ জন লোক বসিয়ে। টাকা পয়সাও উঠিয়ে নিচ্ছেন।’ এসবের পাশাপাশি চাঁদাবাজিসহ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অভিযোগও রয়েছে মুকুলের বিরুদ্ধে। স্থানীয় একটি ইলেকট্রনিক্সের দোকানে গিয়ে কম দামে পণ্য নিতে চাইলে রাজি না হওয়ায় ৩ জনকে মারধর করে পাঠান হাসপাতালে।
তালিকায় সরোয়ার আলম বিপ্লব ও ফরিদ মিয়া
মুকুল খাঁ’র পাশাপাশি উপজেলা বিএনপি’র আহ্বায়ক সরোয়ার আলম ও পৌর বিএনপির সদস্য সচিব ফরিদ মিয়া’র বিরুদ্ধেও পাওয়া গেছে দখল চাঁদাবাজির অভিযোগ। ভাইরাল হওয়া একটি অডিও রেকর্ডে শোনা যায়, ৩টি সেতু নির্মাণ কাজের ঠিকাদারের কাছে ৩ লাখ টাকা চাঁদা চাইছেন আন্দোলন সংগ্রামে না থাকা সরোয়ার। চন্দ্রহার এলাকার সবুজ মোল্লা’র সঙ্গে ফোনে ওই কথা বলছিলেন সরোয়ার। অডিও রেকর্ড আকারে যা পরে ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।
নিজেকে বিএনপির কর্মী জানিয়ে চাঁদা না দেওয়া বা কম দেওয়ার কথা বললে সরোয়ার বলেন, ‘আওয়ামী লীগ আমলে টাকা না দিয়া কাম পাইছে? বিএনপি হইছো তাই মাফ পাবা?’
এছাড়াও বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে চাঁদাবাজি-সন্ত্রাসের অভিযোগ উঠেছে জাতীয় পার্টির আমলে প্রভাবশালী এক মন্ত্রীর এপিএস থাকা সরোয়ারের বিরুদ্ধে।
ফরিদ মিয়া’র বিরুদ্ধেও উঠেছে কাউন্টার দখলসহ চাঁদাবাজির অভিযোগ। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পরপরই হানিফ পরিবহণের কাউন্টার দখল করেন তিনি। বন্দরের একাধিক ব্যবসায়ী জানান, ‘ফরিদ মিয়া’র ভাই নাসির মিয়া ছিল যুবলীগ নেতা। আওয়ামী আমলের পুরো সময় এই ভাইয়ের জোর দেখিয়ে চলেছেন ফরিদ। নাসির ছিল সাবেক মেয়র হারিসুর রহমানের ক্যাডার। বাসস্ট্যান্ড এলাকায় নাসিরের রয়েছে মিষ্টি আর ফরিদের হার্ডওয়ারের দোকান। ৫ আগস্টের পর নাসির এলাকা ছাড়া হলে তার দোকানও দেখাশোনা করছেন তিনি।
দখলবাজি চলছেই
গৌরনদী বাস স্ট্যান্ডে থাকা ১৪টি কাউন্টার দখল হয়ে যায় ৫ আগস্টের পরপরই। বিএনপি ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতারা দখল করে নেয় তা। উপজেলার সব সরকারি-বেসরকারি দপ্তরেও এখন বিএনপি নেতাদের আধিপত্য। তাদের কথা ছাড়া সিদ্ধান্ত নিতে পর্যন্ত পারছেন না সরকারি কর্মকর্তারা।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে মিজানুর রহমান মুকুলকে ফোন দেওয়া হলে ‘একটি সালিশে আছেন পরে কথা বলবেন’ জানিয়ে কেটে দেন ফোন। এরপর বহুবার ফোন আর খুদে বার্তা পাঠানো হলেও সাড়া মেলেনি তার।
ভাই নাসির যুবলীগ করতেন কিনা তা তার কাছ থেকে জানার পরামর্শ দেন ফরিদ। কাউন্টার দখলের কথা স্বীকার করলেও চাঁদাবাজি সন্ত্রাসে জড়িত নয় দাবি তার। যুবলীগ নেতা ভাইয়ের দোকান চালানো বিষয়ে বলেন, ‘দোকান তো তার নয়, পারিবারিক।’
সরোয়ার আলম বলেন, ‘অডিও রেকর্ড একটা ষড়যন্ত্র। আমায় ফাঁসাতে পরিকল্পিতভাবে করা হয়েছে। ওখানে কাজ নিয়ে দু’পক্ষের মধ্যে ঝামেলা হয়। আমি মীমাংসার কথা বলেছি। চাঁদাবাজি সন্ত্রাসের অভিযোগ ষড়যন্ত্র।’