কমলগঞ্জে মণিপুরী মহারাসলীলা ১৫ নভেম্বর, চলছে প্রস্তুতি
কমলগঞ্জ (মৌলভীবাজার) প্রতিনিধি
প্রকাশ: ১১ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:৫৪ পিএম
আগামী ১৫ নভেম্বর মহারাসলীলা। মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার মাধবপুর ও আদমপুরের মণিপুরী গ্রামগুলো এখন রাস উৎসবের আয়োজনে ব্যস্ত। চলছে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি।
উৎসবের রং ফুটেছে মণিপুরী অধ্যুষিত গ্রামেগুলোতে। পাড়ায় পাড়ায় নৃত্যের কসরত চলছে। মণ্ডপে মণ্ডপে বাহারি রঙে সাজসজ্জা আর এলাকার বাড়িগুলোতে বাজছে সুরধ্বনি। কোনো জায়গায় রাখাল নৃত্যের মহড়া, কোথাও আবার রাসনৃত্যের মহড়ায় ঘষামাজা করছেন প্রশিক্ষকরা।
উপজেলার মাধবপুর ইউনিয়নের শিমুলতলায় অনিলের বাড়িতে প্রশিক্ষক অজিত কুমার সিংহ বলেন, এখানে দুই দফায় প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। সকালে শিশু-কিশোরদের রাখাল নৃত্যের ও বিকালে কিশোরীদের কৃষ্ণের সখ্য ও বাৎসল্য রসের বিবরণের নৃত্যের কসরত করানো হয়। আমার এখানে দুই দফায় প্রায় ৩০-৩৫ জন কিশোর-কিশোরী প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। আশা করি, তারা আগামী ১৫ নভেম্বর ভালোভাবেই নৃত্য প্রদর্শন করতে পারবে।
ভাগবাড়ী গ্রামের প্রশিক্ষক অনিতা সিংহা বলেন, এখানে ৩৫-৪০ জনকে শিশুদের রাখাল নৃত্য ও কিশোরীদের রাসনৃত্যের জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। তারা ভালোভাবে নৃত্যের প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। এখন শেষপর্যায়ে অনুশীলন চলছে।
প্রশিক্ষক ললিত কুমার সিংহ বলেন, এখানে শিশু-কিশোরদের রাধা ও কৃষ্ণের গোষ্ঠী লীলায় রাখাল সাজে কৃষ্ণের বালক বেলাকে উপস্থাপন করার প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে।
প্রশিক্ষণার্থী প্রীতি সিংহা, স্বর্নালী সিংহা, যমুনা সিংহা, অর্নী ও তিশা বলেন, আমরা অপেক্ষায় থাকি কখন রাস উৎসব আসবে এবং উৎসবের একজন গর্বিত শিল্পী হতো পারবো। এখানে সুযোগ পেতে হলে অনেক পরিশ্রম করতে হয়। এবার আমাদের ভাগ্য ভালো। আমরা সুযোগ পেয়েছি। উস্তাদরা রাধা ও কৃষ্ণের লীলার নৃত্য কসরত শিখিয়েছেন। উৎসবের দিন ভালোভাবে প্রদর্শন করতে পারলেই নিজের সাধনা ও কষ্ট সার্থক হবে।
মাধবপুর রাস উদযাপন কমিটির সভাপতি যোগেশ্বর চ্যাটার্জী বলেন, আমাদের এখানে এ বছর ১৮২তম রাস উৎসব অনুষ্ঠিত হবে। এখানে ৩টি মণ্ডপে রাস প্রদর্শন হবে। মণ্ডপসমূহের সাজ-সজ্জার কাজ চলছে। জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে উৎসব নির্বিঘ্নে করার জন্য নিরাপত্তা জোরদার ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দেওয়া হয়েছে।
মাধবপুরের রাসমেলার আয়োজক হচ্ছে মণিপুরী মহারাসলীলা সেবা সংঘ। মণিপুরী বিষ্ণুপ্রিয়া সম্প্রদায়। উৎসবস্থল শিববাজার উন্মুক্ত মঞ্চ প্রাঙ্গণে হবে গোষ্ঠলীলা বা রাখাল নৃত্য, রাতে জোড় মণ্ডপে রাসের মূল প্রাণ মহারাসলীলা।
অন্যদিকে ১৯৮৬ সাল থেকে কমলগঞ্জের আদমপুরে মণিপুরী মৈতৈ সম্প্রদায় আয়োজন করছে পৃথক রাসমেলার। এবার ৪২তম উৎসব।
পূর্ণিমার দিন সকালে পাপমোচন ও পূণ্য লাভের আশায় সনাতন ধর্মাবলম্বীরা দলে দলে পূজা-অর্চনা পাঠ ও পুণ্যস্নান করেন। মণিপুরী সনাতন ধর্মের একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের উৎসব হলেও দিনে দিনে রাস উৎসব হয়ে উঠছে সর্বজনীন উৎসব। এখানেও থাকবে যথারীতি রাখাল নৃত্য ও রাসলীলা।
মাধবপুর মণিপুরী মহারাসলীলা সেবা সংঘের সাধারণ সম্পাদক শ্যাম সিংহ এবং আদমপুর মহারাস উদযাপন কমিটির অন্যতম নেতা ইবুংহাল সিংহ শ্যামল বলেন, রাস উৎসবকে সফল করতে এক মাস ধরে ছয়টি বাড়িতে রাসনৃত্য ও রাখালনৃত্যের মহড়া চলছে। এর মধ্যে ৩টি বাড়িতে রাসনৃত্য ও ৩টিতে রাখাল নৃত্য।
মাধবপুর ও আদমপুরে রাসমেলার আয়োজকরা জানিয়েছেন, মহারাসলীলার মূল উপস্থাপনা শুরু হবে দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে ‘গোষ্ঠলীলা বা রাখালনৃত্য’ দিয়ে। গোষ্ঠলীলায় রাখাল সাজে কৃষ্ণের বালক বেলাকে উপস্থাপন করা হবে।
এতে থাকবে কৃষ্ণের সখ্য ও বাৎসল্য রসের বিবরণ। গোধূলি পর্যন্ত চলবে রাখালনৃত্য। সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান রাত ১১টা থেকে পরিবেশিত হবে মধুর রসের নৃত্য বা শ্রী শ্রীকৃষ্ণের মহারাসলীলানুসরণ। রাসনৃত্য ভোর (ব্রাহ্মমুহূর্ত) পর্যন্ত চলবে। রাসনৃত্যে গোপিনীদের সঙ্গে কৃষ্ণের মধুরলীলার কথা, গানে ও সুরে ফুটিয়ে তুলবেন শিল্পীরা।
রাসোৎসবে মণিপুরী সম্প্রদায়ের লোকজনের পাশাপাশি অন্যান্য জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে হাজার হাজার লোকজন মেতে উঠবে এ একদিনের আনন্দ উৎসবে। মহারাত্রির আনন্দের পরশ পেতে আসা হাজার হাজার নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোর, কবি-সাহিত্যিক, সাংবাদিক, দেশি-বিদেশি পর্যটক, বরেণ্য জ্ঞানী-গুণী লোকজন সহ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের পদচারণায় মুখরিত হয়ে উঠবে মাধবপুর ও আদমপুরের মণ্ডপ প্রাঙ্গণ।
রাসোৎসবকে ঘিরে মাধবপুর ও আদমপুরের মণ্ডপগুলো সাজানো হচ্ছে সাদা কাগজের নকশার নিপুণ কারুকাজে। করা হচ্ছে আলোকসজ্জাও। সেখানে মণিপুরী শিশু নৃত্যশিল্পীদের সুনিপুণ নৃত্যাভিনয় রাতভর মনমুগ্ধ করে রাখবে লাখো ভক্ত ও দর্শনার্থীদের।
মণিপুরী পল্লীর এ উৎসবে দেশের বিভিন্ন স্থানসহ ভারত থেকেও মণিপুরী সম্প্রদায়ের লোকজনসহ জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে অনেকেই ছুটে আসেন মহারাসলীলা অনুষ্ঠান উপভোগের জন্য।
কমলগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জয়নাল আবেদীন ও কমলগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) সৈয়দ ইফতেখার হোসেন বলেন, আয়োজকদের সঙ্গে কথা বলে নিরাপত্তার জন্য দুই স্থানেই যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
রাসলীলায় মণিপুরী নৃত্য শুধু কমলগঞ্জের নয়, গোটা ভারতীয় উপমহাদেশের তথা সমগ্র বিশ্বের নৃত্যকলার মধ্যে একটি বিশেষ স্থান দখল করে নিয়েছে। ১৯২৬ সালের সিলেটের মাছিমপুরে মণিপুরী মেয়েদের পরিবেষ্টিত রাসনৃত্য উপভোগ করে মুগ্ধ হয়েছিলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। পরে কবিগুরু কমলগঞ্জের নৃত্য শিক্ষক নীলেশ্বর মুখার্জীকে শান্তি নিকেতনে নিয়ে সেখানে মণিপুরী নৃত্য শিক্ষার প্রবর্তন করেছিলেন।