‘আমা দাবালাম’ পর্বত জয় কিশোরগঞ্জের শাওনের
কিশোরগঞ্জ ব্যুরো
প্রকাশ: ০৪ নভেম্বর ২০২৪, ১০:৪৫ পিএম
এবার কিশোরগঞ্জের যুবক তানভীর আহমেদ শাওন জয় করলেন হিমালয় পর্বতমালার ‘আমা দাবালাম’ পর্বত। লেদার ইঞ্জিনিয়ার শাওন রোববার, ৩ নভেম্বর সকালে ২২ হাজার ৩৪৯ ফুট উচ্চতার ‘আমা দাবালাম’ শৃঙ্গে উঠে বাংলাদেশের লাল-সবুজের পতাকা উড়িয়েছেন।
কিশোরগঞ্জের একজন পর্বতারোহীর সর্বোচ্চ পর্বত শৃঙ্গ জয়ের রেকর্ডের ঘটনা এখন বিভিন্ন বয়সের নারী-পুরুষের মুখে মুখে।
জানা গেছে, শাওন কিশোরগঞ্জ জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও কৃতী ফুটবলার তারেক উদ্দিন আহমেদ আবাদ ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক শিরিন আহমেদ শিউলি দম্পতির প্রথম সন্তান।
তারেক উদ্দিন আহমেদ ও শিরিন আহমেদ জানান, তাদের দুই সন্তানের মধ্যে ছোট ছেলে সিভিল ইঞ্জিনিয়ার সোহান আহমেদ তন্ময়ও বড়ভাই শাওনের সঙ্গে ২০২১ সালে হিমালয়ের অন্য একটি পর্বত ‘চুল্লু ফাড়ি’ জয় করে এসেছে। এবার শাওন জয় করল ‘আমা দাবালাম’ পর্বত শৃঙ্গ। শাওন বর্তমানে একটি আমেরিকান সংস্থা ভিএফ কর্পোরেশনের সিনিয়র প্ল্যানার পদে কর্মরত আছে। সে ২০১৪ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘ভার্টিকাল ড্রিমার্স’ নামে একটি পর্বতারোহী ক্লাবের অর্থ সম্পাদকের দায়িত্বেও রয়েছে। ‘স্নোয়ি হরাইজন টেক্স অ্যান্ড অ্যাক্সপেডিশন’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞপ্তির সূত্রে শাওনা ‘আমা দাবালাম’ জয়ের মনস্থির করে।
শিরিন আহমেদ জানান, ‘আমা দাবালাম’ পর্বতটি খুবই খাড়া প্রকৃতির। এই পর্বতশৃঙ্গ জয় করতে গিয়ে এ পর্যন্ত ৩৪ জন আরোহী প্রাণ হারিয়েছেন। যে কারণে শাওনকে নিয়ে খুব দুশ্চিন্তায় ছিলেন তিনি কিন্তু শাওন নাছোড়বান্দা। সে যাবেই।
শাওন ১৩ অক্টোবর নেপালের উদ্দেশ্যে দেশ ছাড়েন। ১৫ অক্টোবর তিনি নেপালের বামেছাপ বিমানবন্দরে পৌঁছালেও বৈরী আবহাওয়ার কারণে সেখানে দুদিন অপেক্ষা করতে হয়। আবহাওয়া কিছুটা ভালো হলে তিনি কিছুটা পথ হেঁটে এবং কিছুটা পথ গাড়িতে করে ‘আমা দাবালাম’ পর্বতের বেস ক্যাম্পে পৌঁছান ২৪ অক্টোবর। সেখানকার পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে তিনি বেস ক্যাম্প থেকে একবার ক্যাম্প-২ ঘুরে আসেন। তখনও বৈরী আবহাওয়া ছিল। যে কারণে আবার অপেক্ষার পালা। আবহাওয়ার উন্নতি হলে গাইড বীর তামাংকে সঙ্গে নিয়ে তিনি ১ নভেম্বর রওনা দিয়ে উঠে যান ক্যাম্প-২ এ।
সেখান থেকে ২ নভেম্বর মধ্যরাতে রওনা হন ‘আমা দাবালাম’ পর্বত শৃঙ্গের উদ্দেশ্যে। রোববার সকালে তিনি দেশের লাল-সবুজের পতাকা নিয়ে ওঠে যান আমা দাবালামের শৃঙ্গে। সেদিনই তিনি বেস ক্যাম্পে নেমে আসেন। তবে আবহাওয়া বৈরী থাকার কারণে তিনি মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেননি। তবে আজ সোমবার সকালে তিনি মায়ের কাছে দেশের পতাকা নিয়ে ‘আমা দাবালাম’ শৃঙ্গে আরোহণের ছবি পাঠিয়েছেন। মায়ের মনেও স্বস্তি ফিরে এসেছে।
মা শিরিন আহমেদ আরও জানান, বৈরী আবহাওয়ার কারণে তিনি ছেলেকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় ছিলেন। কয়েক দিন মোবাইল ফোনেও যোগাযোগ করা যাচ্ছিল না। যেহেতু এর আগে ওই পর্বতে আরোহণ করতে গিয়ে ৩৪ জনের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে, সে কারণেই আরও বেশি আতঙ্কে ছিলেন তিনি । অবশেষে শৃঙ্গ জয়ের ছবি পেয়ে শিরিন আহমেদের মনে স্বস্তি ফিরে এসেছে। মা শিরিন আহমেদ অত্যন্ত খুশি এবং গর্ববোধ করছেন ছেলের এমন একটি বিরল কৃতিত্ব অর্জনে।
মা শিরিন আহমেদ জানান, এই অভিযানে প্রায় ৮ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। শেরপাকেই দিতে হয়েছে এক লাখ টাকা। আরোহীদের বিশেষ পোশাক কিনতে খরচ হয় ৯০ হাজার টাকা। সেটি দিয়েছে তার চাকরির প্রতিষ্ঠান। বাকি টাকা নিজেকে খরচ করতে হয়েছে। হিমালয়ের খুম্বু অঞ্চলের সুপার টেকনিক্যাল পিক ‘আমা দাবালাম’ প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে জয় করেছিলেন বাবর আলী। এরপর নিশাত মজুমদার, কাউসার রূপক ও তৌফিক তমালও ওই পর্বত জয় করেন। তারাই ছিলেন শাওনের অনুপ্রেরণার উৎস। শাওন হলেন এই পর্বত জয় করা পঞ্চম বাংলাদেশি। ‘আমা দাবালাম’ অভিযানে যাওয়ার প্রস্তুতি হিসেবে শাওন গত তিন মাসে ৭০০ কিলোমিটার দৌড়েছেন। কার্ডিও প্র্যাকটিস করেছেন ২৮ ঘণ্টা।
শাওন এর আগে ভারতের ৬ হাজার ৩০৭ মিটার উচ্চতার ‘দেও তিব্বা’ পর্বত, ৬ হাজার ৩০৭ মিটার উচ্চতার ‘রামজাক’ পর্বত এবং নেপালের ৬ হাজার ৫৯ মিটার উচ্চতার ‘চুল্লু ফারইস্ট’ পর্বত শৃঙ্গও জয় করেন।
শাওনের স্ত্রী সহপাঠী নিগার পারভীনও একজন লেদার ইঞ্জিনিয়ার। তারা দুজন ২০০৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লেদার ইনস্টিটিউট অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। তার স্ত্রী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি করার পর এখন নিজেই একটি লেদার ইঞ্জিনিয়ারিং প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। এই দম্পতির মির্জা আহমেদ এরিন নামে দুই বছরের একটি কন্যাসন্তান রয়েছে।
ছেলের নানামুখী প্রতিভা ও শখের বর্ণনা দিতে গিয়ে মা শিরিন আহমেদ জানান, চিত্রাঙ্কন ও মোমের কারুকাজে শাওন বিশেষ পারদর্শী। বাগান ও ব্যক্তিগত পাঠাগারের প্রতি তার বেশ নেশা। তার পাঠাগারে প্রায় এক হাজার বইয়ের সংগ্রহ রয়েছে। শাওন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন নিয়মিত ফুটবলার ছিলেন। ছিলেন ব্যাডমিন্টন খেলোয়াড়। রক্তদান সমিতি বাঁধনের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদকও ছিলেন। শাওন সাইক্লিং পছন্দ করেন। গত ঈদুল ফিতরের সময় তিনি দেশের পূর্ব-পশ্চিম দিকে ৪৮৪ কিলোমিটার সলো ক্রস কান্ট্রি সাইক্লিং করেন। নিয়মিত ম্যারাথনেও অংশ নেন।