কইছিন বাজার-সদাই লইয়া আইলে বাচ্চারা খাইব, আর আইলো না!
কামাল হোসাইন, নেত্রকোনা
প্রকাশ: ০৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৭:০৩ পিএম
৫ আগস্ট সকাল ৯টার দিকে ঢাকার সাভারের আশুলিয়া এলাকার ভাড়াবাসা থেকে বের হন সাব্বির ইসলাম (৪৪)। দিনমজুরি করে চাল-ডালসহ নিয়ে ঘরে ফেরার ইচ্ছা ছিল তার। কিন্তু তা আর হলো না। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে গুলিবিদ্ধ হয়ে তিনি ঘটনাস্থলেই মারা যান।
সেই দিনের কথা বলতে গিয়ে সাব্বিরের স্ত্রী ফরিদা আক্তার বলেন, ‘কইছিন বাজার-সদাই লইয়া আইলে বাচ্চারা খাইব, আর আইলো না!’
নেত্রকোনার আটপাড়া উপজেলার লুনেশ্বর ইউনিয়নের খিলা বাউন্দি গ্রামের মৃত শুকুর আলীর ছেলে সাব্বির ইসলাম। ওই উপজেলার বানিয়াজান এলাকায় তার পরিবারের লোকজন বাস করে। তার তিন মেয়ে ও এক ছেলে। ১২ বছর বয়সি ছেলে মো. মমিন মিয়া বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী। বড় মেয়ে লিজা আক্তার (১৫) চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করে টাকার অভাবে আর পড়তে পারেনি। অভাবের সংসার কোনোমতে চলছিল তার। একমাত্র উপার্জনক্ষম সাব্বিরের মৃত্যুতে পরিবারটি পথে বসেছে।
জেলার আটপাড়া উপজেলার বানিয়াজান এলাকায় নিহত সাব্বির ইসলামের স্ত্রী ফরিদা আক্তার বলেন, ‘এহন আমি কেমনে চার সন্তান লইয়া চলবাম? সবই শেষ হইয়া গেছে আমার। ছেড়াও (ছেলেটিও) প্রতিবন্ধী, মেয়েও বড় হইছে বিয়া দেওন লাগব। আমার মাথায় কিছুই ধরে না। আমি চক্ষে আন্দার দেখি।’
পরিবার ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, সাব্বির ইসলাম প্রায় দুই দশক আগে বানিয়াজান গ্রামের জামাল উদ্দিনের মেয়ে ফরিদা আক্তারকে বিয়ে করেন। বিয়ের পর তিনি শ্বশুরবাড়ি এলাকায় চলে যান। তার শ্বশুরও দরিদ্র। সেখানে কুঁড়েঘরে বসবাসের পাশাপাশি দিনমজুরিসহ বিভিন্ন কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে চলতেন সাব্বির; কিন্তু বছর সাতেক আগে সেই কুঁড়েঘরটিও ভেঙে পড়ে গেছে তার। জীবিকার তাগিদে ঢাকার আশুলিয়া এলাকায় গিয়ে একটি সরিষা তেলের কারখানায় কাজ নেন তিনি। সেখানে স্ত্রী, আর চার সন্তান নিয়ে কোনোরকমে খেয়ে না খেয়ে চলে যাচ্ছিল তার সংসার।
গত জুলাইয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন শুরু হলে কারখানাটি বন্ধ হয়ে যায়। বেকার হয়ে পড়ে সাব্বির। ৫ আগস্ট সকালে কাজের সন্ধানে বাসা থেকে বের হয়ে দিনমজুরি শেষে বাজার করে ঘরে ফেরার কথা ছিল তার। বাচ্চারা অপেক্ষা করছিল খাবার নিয়ে এলে খাবে। পরিস্থিতি দেখে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগ দেয় সাব্বির। আন্দোলনে সংঘর্ষ চলাকালে বেলা ১১টার দিকে সাভারের বাইপাইল এলাকায় তার ডান কানের পাশ দিয়ে একটি গুলি ঢুকে মাথার পেছন দিয়ে বের হয়ে যায়। এতে ঘটনাস্থলেই তিনি মারা যান। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম সাব্বিরকে হারিয়ে দিশেহারা তার স্ত্রী ফরিদা আক্তার।
ফরিদা বলেন, ‘আন্দোলন শুরু হওয়ার কারণে কারখানা বন্ধ হইয়া যায়। কাজকাম না থাহনে ধারদেনা কইরা চলছিলাম। পোলাপান ক্ষুধার জ্বালায় ছটফট করছিল। ওদের বাপ খাওন নিয়ে আইলে খাইত। শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি আর সংসারে অভাব দেইখখা আমার স্বামী আন্দোলনে যোগ দেয়।
তিনি বলেন, ৫ আগস্ট ঘর থাইক্কা বাইর হওনের সময় কইছিল, ‘বাজার-সদাই লইয়া আইমু। কাম না পাইলে ছাত্রদের লগে আন্দোলনে গিয়া সরকার পতন ঘটাইয়া ঘরে ফিরমু। কিন্তু সরকার পতন ঠিকই হইল, আমার স্বামী তো আর ফিরল না। পোলাপান নিয়া আমি অহন কিভাবে চলবাম? যারা আমার স্বামীরে মারল, তাদের বিচার আল্লাহর কাছেই দিলাম।’
ফরিদা আক্তারের ভাই মো. চঞ্চল মিয়া বলেন, গুলিতে নিহত সাব্বির রাস্তায় পড়ে ছিলেন। একজন সাব্বিরের ফোন থেকে কল করে ফরিদাকে বিষয়টি জানান। পরে তারা একটি পিকআপভ্যানে করে লাশ আটপাড়ার বানিয়াজান গ্রামে নিয়ে যান রাত পৌনে ৪টায়। ৬ আগস্ট জানাজা শেষে দুপুর ১২টায় তার লাশ দাফন করা হয়।
সাব্বিরের প্রতিবেশী চুন্নু খান বলেন, সাব্বির খুবই নিরীহ প্রকৃতির ভালো মানুষ ছিল। আন্দোলনে গিয়ে নিহত হওয়ায় তার পরিবার এখন খুবই বিপদে পড়েছে। সরকার ও বিত্তবানরা সহযোগিতার হাত বাড়ালে বাচ্চাদের নিয়ে সাব্বিরের স্ত্রী ফরিদা ভালোভাবে বাঁচতে পারত।
এ বিষয়ে আটপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এম সাজ্জাদুল হাসান যুগান্তরকে বলেন, জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিহত শ্রমিক সাব্বির ইসলামের পরিবারকে ২৫ হাজার টাকার চেক দেওয়া হবে। এছাড়া পরিবারটিকে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সহযোগিতা করা হবে।