পুলিশ কর্মকর্তা শহীদুল-কাফীর নেতৃত্বেই চলে হত্যাযজ্ঞ
জাভেদ মোস্তফা, যুগান্তর প্রতিবেদন (ঢাকা উত্তর)
প্রকাশ: ০১ নভেম্বর ২০২৪, ০৮:৪৫ পিএম
৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পদত্যাগের একদফা দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচিতে পুলিশ গুলি ছুড়ে নির্বিচারে মানুষ হত্যা করেছে। আন্দোলনের সূচনা থেকে এ পর্যন্ত সাভারে মারা গেছেন ছাত্রছাত্রীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার প্রায় ১৫৮ জন মানুষ। গুলিবিদ্ধ হয়েছেন দুই শতাধিক। যাদের অনেকেই পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন।
এসব হত্যাকাণ্ডের নেতৃত্বে ছিলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় আশুলিয়ায় লাশ পোড়ানোর ঘটনায় গ্রেফতার হওয়া ঢাকা জেলার সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সাভার সার্কেল) শহীদুল ইসলাম।
বুধবার কক্সবাজার থেকে গ্রেফতার হওয়ার পর কড়া পুলিশি নিরাপত্তায় শহীদুল ইসলামকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়। তার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় পরোয়ানা জারি করেছিল আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল। শুক্রবার শহীদুলকে কারাগারে পাঠান ট্রাইব্যুনাল।
সাভারের আলোচিত আসদুল ইয়ামিন হত্যা মামলারও অন্যতম আসামি তিনি। ইয়ামিনকে গুলি করার পরে অচেতন অবস্থায় এপিসি (আর্মার্ড পার্সেসোনাল ক্যারিয়ার) থেকে ফেলে দেওয়া হয়। সেই দৃশ্য বিভিন্ন গণমাধ্যমে ভাইরাল হয়। সে সময় শহীদুল সাভার মডেল থানার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ছিলেন।
এসব কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার শতাধিক অভিযোগ রয়েছে গত ২ সেপ্টেম্বর পালানোর সময় বিমানবন্দর থেকে গ্রেফতার হওয়া ঢাকা জেলার বরখাস্ত অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আব্দুল্লাহিল কাফীর বিরুদ্ধেও। তারা দুজন শতাধিক ছাত্র-জনতা হত্যাকাণ্ডের পাশাপাশি স্থানীয় বিএনপি জামায়াতের নেতাকর্মীসহ আন্দোলনে অংশ নেওয়া লোকজনের বাড়িতে ঢুকে চালাত ভাঙচুর ও লুটপাট। হাতিয়ে নিত লাখ লাখ টাকা। তাদের সঙ্গে স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ সংগঠনের অস্ত্রধারী নেতাকর্মীরাও থাকতেন বলে অভিযোগ ভুক্তভোগীদের।
এ কারণেই আন্দোলন চলাকালে বিক্ষুব্ধ জনতা সাভার, আশুলিয়া ও ধামরাইয়ের তিনটি থানায় ভাঙচুর চালিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। এ সময় প্রাণ হারায় পুলিশের ৫ সদস্য।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকা কর্মসূচি ঘিরে গত ১৮ জুলাই শান্তিপূর্ণ অবস্থান কর্মসূচিতে সাভারে যোগ দেন কয়েক হাজার সাধারণ শিক্ষার্থী। সেদিন শিক্ষার্থীদের এই শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে স্থানীয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগ কর্মীরা অবৈধ অস্ত্র হাতে নির্বিচারে গুলি চালায় ছাত্র জনতার ওপর। এ সময় তাদের পাশেই ছিলেন পুলিশ ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া একাধিক ভিডিওতে দেখা যায় পুলিশের এপিসির উপরে গুলি খেয়ে পড়ে আছেন মিরপুরের মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির (এমআইএসটি) মেধাবী শিক্ষার্থী শাইখ আসহাবুল ইয়ামিন। সেই এপিসির পাশেই আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে অগ্রসর হচ্ছেন শহীদুল ইসলাম, সাভার উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি আতিকুর রহমান ও তার সন্ত্রাসী বাহিনী।
আন্দোলন মোকাবেলা ও শৃঙ্খলা বজায় রাখার বিষয়ে সেদিন আব্দুল্লাহিল কাফী ও শহীদুল ইসলামের নেতৃত্বে পুলিশ শিক্ষার্থীদের উপর নির্বিচারে গুলি চালায়। পাশাপাশি ছাত্রলীগের অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরাও হামলা চালায় নিরস্ত্র শিক্ষার্থীদের উপর। আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের সদস্যরা সেদিন প্রকাশ্যে অবৈধ অস্ত্র নিয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি করলেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি পুলিশ। মূলত শাইখ আসহাবুল ইয়ামিনের মৃত্যুর পর থেকেই বিক্ষোভে ফেটে পড়ে সাভারের সর্বস্তরের জনতা।
নিহত ইয়ামিনের বাবা মো. মহিউদ্দিন বলেন, গুলিবিদ্ধ হওয়ার পরেও আমার ছেলে জীবিত ছিল; কিন্তু পুলিশ আমার ছেলেকে চিকিৎসার সুযোগ না দিয়ে এভাবেই তাদের সাঁজোয়া জানের উপর রেখে ঘুরে বেড়িয়েছে। একপর্যায়ে আমার ছেলেকে নির্মমভাবে গাড়ির উপর থেকে রাস্তায় ফেলে টেনেহিঁচড়ে রোড ডিভাইডারের উপর দিয়ে অন্যপাশে ছুড়ে ফেলে দেয়। একজন জীবন্ত মানুষকে এভাবে কোনো মানুষ নিচে ফেলে দিতে পারে না।
তিনি বলেন, কাফী ও শহীদুল এই হত্যাকাণ্ডের নেতৃত্বে ছিলেন। তারা আমার ছেলেকে হত্যা করেছে সেটি দিবালোকের মতো স্পষ্ট। এখন সরকার যদি চায় তাহলে তাদের কঠিন বিচার করবে।
ওই দুই পুলিশ কর্মকর্তার তাণ্ডবে রেহাই পায়নি সাংবাদিকরাও। ৫ আগস্ট সকালে শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে ছোড়া বুলেটে আহত হন সাংবাদিক সৈয়দ হাসিবুন নবী ও খোকা মোহাম্মদ চৌধুরী। গত ১৮ জুলাই সাভার প্রেস ক্লাবের সামনে দাঁড়য়ে থাকা পিয়ন মনঞ্জয়কে কাছ থেকে গুলি করায় তার ডান হাতটি কেটে ফেলতে হয়েছে। এছাড়া ২১ জুলাই সাভার বাসস্ট্যান্ড এলাকায় তার নির্দেশে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শহীদুল ইসলামের নেতৃত্বে ব্যাপক হামলা ভাঙচুর ও নিরীহ মানুষের ঘরবাড়ি ও অফিসে গুলিবর্ষণসহ হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করা হয়। ক্ষতিগ্রস্ত হয় যুগান্তর সাংবাদিক জাভেদ মোস্তফার মালিকানাধীন নাজ প্যালেসে অবস্থতি দৈনিক যুগান্তরের কেয়ারটেকার অফিস। এ সময় যুগান্তর কেয়ারটেকারের রুমের ভিতর কাছ থেকে গুলিবর্ষণে আহত হন ইসমাইল ও হৃদয় নামের সাংবাদিক জাভেদ মোস্তফার দুইজন ভাড়াটিয়া। একই দিন স্থানীয় স্বনীকা এলাকায় দৈনিক ফুলকির অফিসেও গুলিবর্ষণ ও ভাঙচুর করা হয় শহীদুল ইসলামের নেতৃত্বে।
এর আগে ১৭ জুলাই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আব্দুল্লহিল কাফীর উপস্থিতিতে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শহীদুল ইসলামসহ অন্য পুলিশ সদস্যরা প্রথম আলোর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি আব্দুল্লহ আল মামুনকে বেদম মারধর করে গুরুতর আহত করে ক্যাম্পাস মাঠে ফেলে রেখে যায়।