দ্বিতীয়বার সাফ জয়, ঋতুপর্ণা-রুপনার বাড়িতে খুশির বন্যা
সুশীল প্রসাদ চাকমা, রাঙামাটি
প্রকাশ: ৩১ অক্টোবর ২০২৪, ০৭:০৩ পিএম
এবারও নেপালকে ২-১ গোলে হারিয়ে টানা দ্বিতীয়বার নারী সাফ ফুটবলের শিরোপা জিতেছেন বাংলাদেশের লাল-সবুজের নারী ফুটবল তারকারা। চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা জয়ের পাশাপাশি নিজেদের কৃতিত্ব নিয়ে অর্জন করেছেন সেরা পুরস্কারও।
এর আগে ২০২২ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর একই মাঠে একই প্রতিপক্ষ স্বাগতিক নেপালকে ৩-১ গোলে হারিয়ে সাফ শিরোপা জিতেছিলেন বাংলাদেশের কৃতি নারী ফুটবলাররা।
এবারের সাফের সেরা ফুটবলারের পুরস্কার জিতেছেন বাংলাদেশের রাঙামাটির মেয়ে ঋতুপর্ণা চাকমা। গোল করেছেন খাগড়াছড়ির মেয়ে মনিকা চাকমাও। আর সেরা গোলরক্ষকের খেতাব এসেছে রাঙামাটির রুপনা চাকমার হাতে। এমন খবর ছড়িয়ে পড়লে খুশির বন্যা দেখা দেয় টানা দ্বিতীয়বারের সাফজয়ী নারী ফুটবলার রাঙামাটির ঋতুপর্ণা ও রুপনার বাড়িতে, যা ছড়িয়ে পড়ে জেলাজুড়ে।
খাগড়াছড়ির মনিকা চাকমার বাড়ির এলাকা থেকেও খুশির খবর পাওয়া যায়। বাড়িতে ফিরলে গর্বিত এই নারী ফুটবলারদের সর্বজনীন সংবর্ধনার আয়োজন করা হবে বলে জানিয়েছেন সেরা খেলোয়াড় হয়ে উঠে আসা ঋতুপর্ণাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঘাগড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক চন্দ্রা দেওয়ান।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ বাংলাদেশ দলের নারী ফুটবলার ঋতুপর্ণা চাকমার বর্তমান বয়স ২২। তার বাড়ি রাঙামাটির কাউখালী উপজেলার ঘাগড়া ইউনিয়নের মগাইছড়ি গ্রামে। সেরা গোলরক্ষক রুপনা চাকমার বয়স ২১। তার বাড়ি রাঙামাটির নানিয়ারচর উপজেলার ঘিলাছড়ি ইউনিয়নের দুর্গম পাহাড়ি এলাকা ভুয়ো আদাম গ্রামে।
দুজনের পরিবারেই ছিল আর্থিক অভাব-অনটন। ছোটকালে বাবা হারিয়েছেন দুজনেই। মায়েদের কষ্টের সংসারে থেকে বেড়ে ওঠা তাদের। সেই অবস্থায় বাংলাদেশের মেয়েদের জাতীয় ফুটবল দলে রাঙামাটি থেকে উঠে আসাটা নিঃসন্দেহে যেমনটা খুব কঠিন বিষয়, তেমনি গর্বের।
এভাবে সর্বশেষ টানা দ্বিতীয়বার সাফ চ্যাম্পিয়ন হওয়া বাংলাদেশের দলে কৃতিত্ব অর্জনকারী রাঙামাটির মেয়ে ঋতুপর্ণা ও রুপনার পরিবারে এখন খুশির বন্যা। তাদের কৃতিত্বে গর্বিত গোটা রাঙামাটিবাসী।
জাতীয় দলের সদস্য আর ফুটবল ক্যারিয়ার এক হলেও ঋতুপর্ণা আর রুপনা চাকমার জীবনের গল্প আলাদা। দেশ বিদেশে আলো ছড়ানো ঋতুপর্ণা আর রুপনার বেড়ে ওঠা একেবারে সাধারণ পাহাড়ি পরিবারে। আর এখন তাদের বাড়িতে শোভা পাচ্ছে শিরোপা জয়ের ট্রপি ও পুরস্কারের ছবিসহ নিজেদের দলের অনেকগুলো বাঁধাই করা গ্রুপ ছবি। ঝুলছে বেশকিছু মেডেল। ঘরে সাজিয়ে রাখা হয়েছে অনেকগুলো শিরোপা। এবারও শিরোপা জেতায় খুশির আমেজ তাদের বাড়িজুড়েই। উচ্ছ্বসিত প্রতিবেশীরাও।
ঋতুর মা বসুমতি চাকমা বলেন, শিশু বয়সে ২০১৫ সালে ঋতুর বাবা ব্রজবাঁশি চাকমা মারা গেছেন। এক ভাই ও চার বোনের মধ্যে ঋতু চতুর্থ। একমাত্র ভাই পার্বন চাকমা ২০২২ সালের ২৯ জুলাই বিদ্যুৎস্পৃষ্টে মারা যায়। এখন ঋতুপর্ণার অদম্য কৃতিত্ব আমার বুক বেঁধেছে। এবারও তার শিরোপা জয়ে আমি আনন্দে আপ্লুত। আমি তাদের দলের সবার জন্য আশীর্বাদ করি, যাতে তারা সারা জীবন সাফল্য অর্জন করতে পারে।
গোলবারের নিচে থাকা অতন্দ্র প্রহরী রুপনা। তিনি এবারও সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের সেরা গোলরক্ষক হয়েছেন। রাঙামাটির নানিয়ারচর উপজেলার ঘিলাছড়ি ইউনিয়নের ভুয়ো আদমে তাদের ছিল দুই চালা টিনের একটি কুঁড়েঘর। গতবারের সাফজয়ে তাদের জন্য একটি সেমিপাকা বাড়ি করে দিয়েছে সরকার।
রুপনার মা কালা সোনা চাকমা বলেন, রুপনাদের এবারও জয়ের খবর শুনে আমি খুবই আনন্দিত। রুপনা শুধু আমার সন্তান না। সে এদেশের সবার সন্তান। আমি তো শুধু তাকে গর্ভে ধারণ করেছিলাম। তার সাফল্যের পেছনে যারা, আমি তাদের বুকভরা শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জানাই। রুপনা শিশুকালে তার বাবাকে হারিয়েছে। এরপর দিনমজুরের কাজ করে ছেলেমেয়েদের লালন-পালন করি। এখন রুপনাই আমার ভরসা, সে আমার সব।
পাহাড়ে নারী ফুটবলের আঁতুড়ঘর রাঙামাটির ঘাগড়া উচ্চ বিদ্যালয়। যেখানে ফুটবল দুনিয়ায় হাতেখড়ি হয়েছে পাহাড়ের সন্তান জাতীয় দলের তারকা খেলোয়াড় মনিকা, আনাই, আনুচিং, ঋতুপর্ণা ও রুপনা চাকমার। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিজের বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সাফল্য অর্জনে গর্বিত বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক চন্দ্রা দেওয়ান।
তিনি বলেন, ঋতুদের জয়ের খবরে আমরা খুবই আনন্দিত। তারা আমাদের গর্ব। আমরা তাদের নিয়ে খুব গর্ববোধ করি। তারা বাড়ি ফিরলে আমরা সর্বজনীন সংবর্ধনা দেব।
জেলা প্রশাসক মো. মোশারফ হোসেন বলেন, ঋতুপর্ণা ও রুপনার জন্য পুরো জাতি গর্বিত। আমরা তাদের জন্য সব সময় সাফল্য কামনা করি। তারা বাড়ি ফিরলে আমি তাদের জন্য সংবর্ধনার আয়োজন করব।