ভোল পাল্টে বিএনপি সমর্থক: জাহাঙ্গীরের দখল ও আত্মসাৎ অব্যাহত
জাভেদ মোস্তফা, ঢাকা উত্তর
প্রকাশ: ৩০ অক্টোবর ২০২৪, ১২:১০ পিএম
সুগন্ধা হাউজিং
সাভারের বামনি খালসহ বিভিন্ন ব্যক্তি মালিকানাধীন ও সরকারি খাস জমি অবৈধভাবে দখল ও সরকারি খালের জমিতে বালু ভরাটের ব্যাপক অভিযোগ উঠেছে। স্থানীয়রা জানান, এই অপকর্মের নায়ক সাভারের হেমায়েতপুরের সুগন্ধা হাউজিং প্রপার্টি ডেভেলপমেন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) জাহাঙ্গীর আলম জিতু। দখলবাজি ও আশপাশের জমির মালিকদের জমি আত্মসাতের উদ্দেশ্যে তিনি এলাকার মানুষদের হয়রানি করছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। চিহ্নিত ভূমিদস্যু হিসাবে তার নাম ছড়িয়ে পড়েছে সাভারজুড়ে। বর্তমানে তিনি ভোল পালটে হয়েছেন বিএনপির সমর্থক। একাধিক বিএনপি নেতার সঙ্গে তার সখ্য গড়ে উঠেছে। গণমাধ্যমসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তার বিরুদ্ধে জমি দখল ও জমির মালিকদের হয়রানির অনেক অভিযোগ প্রকাশ হয়েছে। এ ব্যাপারে সাভার মডেল থানায়ও তার বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ রয়েছে। এমনকি হাউজিংয়ের পাশের জমির দখল নিয়ে বিরোধ রয়েছে জমজম হাউজিং ও এসএ হাউজিংয়ের সঙ্গেও।
সুগন্ধা হাউজিংসংলগ্ন চান্দুলিয়া ও বিলামালিয়ায় সরকারি খাস জমি দখলে নিয়ে ভরাট শুরু করলে তৎকালীন সহকারী কমিশনারের (ভূমি) পক্ষ থেকে জমিতে সাইন বোর্ড লাগালেও জমি ভরাটের কার্যক্রম এখনও বন্ধ হয়নি। আওয়ামী লীগ আমলে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারী সাইফুজ্জামান শেখর, সাবেক ডিবি প্রধান হারুন-উর-রশীদ, সাবেক সংসদ-সদস্য ও খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম এবং স্থানীয় সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান ফখরুল আলম সমরের সহযোগিতা নিয়ে দখলবাজি করে বিপুল টাকার মালিক হয়েছেন জাহাঙ্গীর আলম জিতু। তাদের নিয়মিত যাতায়াত ছিল ওই হাউজিংয়ে। তাদের খুশি রাখতে হাউজিংয়ের ভেতর প্লট দেওয়াসহ বাড়ি নির্মাণ করে দেওয়ারও অভিযোগ রয়েছে জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে। পুলিশ ও প্রশাসনকে সব সময়ই ম্যানেজ করে চলেছেন। দেশ-বিদেশে তাদের পরিবারের শত কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে। বিষয়টি দুদকের নজরে আনতে স্থানীয়ভাবে দুর্নীতি দমন কমিশনে অভিযোগ দেওয়া হয়েছে বলেও ভুক্তভোগীরা জানান।
২০১৯ সালে সুগন্ধা হাউজিং প্রপার্টি ডেভেলপমেন্ট এবং আলম নগরের স্বত্বাধিকারী মো. আলম চানের মৃত্যুর পর তার বড় ছেলে হিসাবে জাহাঙ্গীর আলম সুগন্ধা হাউজিংয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। আলমের অন্য দুই ছেলে প্রতিষ্ঠানের পরিচালক হিসাবে কার্র্যক্রম চালাচ্ছেন। জানা গেছে, জাহাঙ্গীর তার বিধবা আপন বড় বোন হোসনে আরার সম্পত্তিও জবরদখল করেছেন। যদিও তার বোন এই প্রতিবেদককে বলেন, এটা পারিবারিকভাবে মীমাংসা হয়ে যাবে বলে জাহাঙ্গীর তাকে জানিয়েছেন।
এছাড়াও রংপুরের এক বিশিষ্ট ব্যবসায়ীর আড়াই কোটি টাকার সম্পত্তি জবরদখলের অভিযোগ পাওয়া গেছে। ওই ব্যবসায়ী মোস্তফা কামাল বেঙ্গল সোমবার সকালে এই প্রতিবেদককে বলেন, ১৯৯৭ সালে এই হাউজিংয়ের সোয়া ৮ শতাংশ জমি (যা ওই হাউজিংয়ের নকশায় ব্লক এ-এর ১০ নম্বর প্লট) জাহাঙ্গীরের বাবা হাজী মো. আলম চান সাফ-কবলা দলিলের মাধ্যমে বিক্রি করেন। কিন্তু ব্যবসায়িক কারণে তিনি ব্যস্ত থাকায় ২০১৭ সালে জানতে পারেন তার প্লটটি দখল হয়ে গেছে। খবর নিয়ে জানতে পারেন জাহাঙ্গীর সেই জমি দখল করে সেখানে বহুতল ভবন নির্মাণ করে ফ্ল্যাট বিক্রি করছেন। এ নিয়ে স্থানীয় জাতীয় পার্টির নেতা তার ঘনিষ্ঠ আত্মীয় আবুল কালামসহ কয়েকবার দেনদরবার করেও তিনি জমির মালিকানা ফিরে পাননি। আবুল কালাম যুগান্তরকে বলেন, জাহাঙ্গীর তার জমি দখল করেছেন বলে স্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, খুব শিগগিরই এ বিষয় মীমাংসা করা হবে। তবে ২০১৮ সালে জাহাঙ্গীরের সঙ্গে দেনদরবার হলেও এ যাবৎ আর কোনো অগ্রগতি হয়নি। কয়েক বছর আগে মোস্তফা কামাল বেঙ্গলকে কিছু টাকার বিনিময়ে জমিটি ফেরত দিয়ে দেওয়ার জন্য প্রস্তাব দেন।
মোস্তফা কামাল বলেন, আমার আড়াই কোটি টাকার সম্পত্তি মাত্র ৭০-৮০ লাখ টাকার বিনিময়ে জাহাঙ্গীর নিয়ে নিতে চান। যা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এ ব্যাপারে এই প্রতিবেদক জাহাঙ্গীরের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বললে তিনি প্রথমে সংযোগ কেটে দেন। পরে আবার ফোন দিলে বলেন, এ বিষয়ে আমার ফ্যামিলির সবার সঙ্গে কথা না বলে কোনো সিদ্ধান্ত দিতে পারব না।
স্থানীয় জমজম হাউজিংয়ের মালিক হাজী নুর মোহাম্মদ যুগান্তরকে বলেন, সুগন্ধার মালিক জাহাঙ্গীর সরকারি খাল দখল করে কয়েকটি ভবন নির্মাণ করেছেন। তৎকালীন ইউএনও এবং সহকারী কমিশনার বিষয়টি দেখে কাজ বন্ধ রাখার কথা বললেও বাস্তবে তা মানা হচ্ছে না।
অন্য একটি অভিযোগে স্থানীয় মাওলানা মো. ওমর ফারুক যুগান্তরকে বলেন, আমরা সুগন্ধা হাউজিংয়ের পাশে প্রায় ১০ কোটি টাকা মূল্যের ৪৫ শতাংশ জমি সাফ-কবলা দলিলের মাধ্যমে ২৫ জন ক্রয় সূত্রে মালিক। সর্বশেষ জরিপেও আমাদের নামে বিআরএস রেকর্ড সঠিকভাবে হয়েছে। হাল খাজনাও দেওয়া আছে। তারপরও ওই জমিতে আমরা বাউন্ডারি ওয়াল বা বাড়িঘর নির্মাণের কাজ করতে পারছি না। তাদের কেয়ারটেকার বাহার বলেন, বাউন্ডারি ওয়ালের কাজ করতেই জাহাঙ্গীরের লোকজন বাধা দেয় ও রাতের আঁধারে সব ভেঙে ফেলে। জমির মালিকরা বলেন, এই ধরনের ঝামেলা সৃষ্টি করে নামমাত্র দামে জাহাঙ্গীর আমাদের সম্পত্তি জোর করে নিতে চান। সাভার মডেল থানায় বেশকিছু অভিযোগ দিলেও প্রশাসনিকভাবে আমরা ন্যায়বিচার পাচ্ছি না।
সাভার সহকারী কমিশনার (ভূমি) রাসেল নূর সোমবার মোবাইল ফোনে যুগান্তরকে বলেন, সুগন্ধা হাউজিংয়ের মালিক জাহাঙ্গীরের ব্যাপারে বর্তমানে চান্দুলিয়া ও বিলামালিয়া খাল দখলের কোনো অভিযোগ নেই। বিলামালিয়া খালের কিছু খাস জমি সুগন্ধা হাউজিংয়ের দখলে ছিল। তা আমরা ২০২২-২৩ সালে উদ্ধার করে সীমানায় সাইনবোর্ড ও গাছ লাগিয়ে দিয়েছি। বর্তমানে সাইনবোর্ড ও গাছ না থাকার বিষয়ে তিনি বলেন, ভারি বৃষ্টিতে গাছগুলো পড়ে গেছে। সাইনবোর্ড সরিয়ে আবার মাটি ভরাট করছে-এমন অভিযোগের বিষয়ে ভূমি কর্মকর্তা রাসেল নূর বলেন, এটা আমিনবাজার ভূমি অফিসের নিয়ন্ত্রণে। তাই নতুন ভূমি কর্মকর্তা যোগদান করার পর এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।