সন্তানের মুখে বাবা ডাক শোনা হয়নি স্বপ্নবাজ রিপনের
সৈয়দ এখলাছুর রহমান খোকন, হবিগঞ্জ
প্রকাশ: ২৮ অক্টোবর ২০২৪, ০৬:৪৫ পিএম
বিয়ে করেছিলেন মাত্র দুই বছর আগে। শুরু করেছিলেন সুখের সংসার। নিজে সেলুন কর্মচারী ছিলেন। অভাব অনুযোগ থাকলেও সুখের কমতি ছিল না তাদের। ৬ মাস আগে জন্ম নেয় একমাত্র ছেলে। নাম রেখেছিলেন আবির বিশ্বাস স্বাধীন।
যেন বুঝতেই পেরেছিলেন দেশ দ্বিতীয়বার স্বাধীন হতে চলেছে। সন্তানকে নিয়ে দেখতেন নানান স্বপ্ন। পড়ালেখা করে অনেক বড় হবে। অথচ সেই স্বপ্নবাজ বাবার বাবা ডাকই শোনা হয়নি সন্তানের মুখ থেকে। সন্তানের মুখে কথা ফুটার আগেই পরপারে চলে গেলেন।
বলছিলাম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শহিদ রিপন শীলের কথা। ৪ আগস্ট দুপুরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালে স্থানীয় এমপি মো. আবু জাহিরসহ আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের ছোড়া গুলিতে শহিদ হন তিনি।
একমাত্র বড় বোন চম্পা রাণী বিশ্বাস ভাইকে হারিয়ে অঝোরে কাঁদছিলেন আর বলছিলেন, ৪ আগস্ট সকাল থেকেই খাওয়ার জন্য পাগল হয়ে উঠেছিল রিপন। পেট পুরে খেয়েছে। আমি আশ্চর্য হলাম। কিরে এমন করে খাচ্ছিস কেন? বলল প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে। খাবারও অনেক স্বাদ হয়েছে। এটিই যে আমার ভাইয়ের শেষ খাবার তাতো বুঝতে পরিনি। খাবার শেষে ছোট ভাই শিপন শীলকে বারবার সাবধান করছিল ঘর থেকে বের হবি না; কিন্তু নিজেই মিছিলে চলে গেল। ছাত্রজীবনে সে ছাত্রদল করত। এটিই তার অপরাধ। আওয়ামী লীগের গুণ্ডারা তাকে হত্যা করেছে। আমি এ হত্যার বিচার চাই। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই হত্যাকারীদের। এখনো আসামিদের উল্লেখযোগ্য কেউ গ্রেফতার হচ্ছে না দেখে আমরা হতাশ হচ্ছি।
শহিদ রিপনের মা মামলার বাদী রুবি রাণী শীল সন্তানকে হারিয়ে বাকরুদ্ধ। কথা বলতে পারছিলেন না তেমন। তিনি বলেন, আমার ছেলে হত্যার বিচার চাই আমি।
বাকরুদ্ধ শহিদ রিপন শীলের স্ত্রী তুষ্টি রাণী শীল। তিনি বলেন, আমার ঠিকমতো সংসার বোঝাই হয়নি। আমার ছেলে বাবাকে ডাকতে পারেনি। তার মুখ থেকে বাবা ডাক ফুটার আগেই বাবা পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। যারা আমার ছেলেকে বাবা হারা করেছে তাদের বিচার আমি চাই।
আহত অবস্থায় রিপনকে হাসপাতালে নেন জেলা যুবদল যুগ্ম আহবায়ক রুবেল আহমেদ চৌধুরী। তিনি বলেন, রিপন আমার কাছেই ছিল। আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসী বাহিনী মুহুর্মুহু গুলি ছুড়তে থাকলে হঠাৎ একটি বুলেট রিপনের পেটে এসে বিদ্ধ হয়। সঙ্গে সঙ্গে সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। আমি তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাই। আমার জামাকাপড় সব রক্তে ভিজে যায়। আমার কোলেই সে মারা গেছে; কিন্তু আমি তা বুঝতে পারিনি। হাসপাতালে নেওয়ার পর যখন ডাক্তার বললেন সে মারা গেছে; তখন কিছুটা ভয় পেয়ে গেলাম। একটা জ্যান্ত মানুষ আমার কোলেই মারা গেছে!
তিনি বলেন, এমন একটি হত্যাকাণ্ডের যদি দৃষ্টান্তমূলক বিচার না হয় তবে শহিদদের আত্মা কষ্ট পাবে। আর দুর্বৃত্তরা বারবারই এমন দুঃসাহস দেখাতে থাকবে।
রিপন শীলের পরিবারকে পুনর্বাসনের অংশ হিসেবে আজীবন স্বাচ্ছন্দ্যে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন হবিগঞ্জ পৌরসভার সাবেক মেয়র ও বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক জিকে গউছ। তিনি বলেন, আমার একটি বাসায় যুগ যুগ ধরে ভাড়া থাকছে পরিবারটি। তারা নিয়মিত ভাড়াও পরিশোধ করে আসছিলেন। এ বাসাতেই তাদের ভাই বোনদের জন্ম হয়। রিপন শহিদ হওয়ার পর আমি তাদের আজীবনের জন্য বাসা ভাড়া মওকুফ করে দিয়েছি। আমার ব্যক্তিগত এবং দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমানের পক্ষ থেকে আর্থিক সহায়তা করেছি।
তিনি বলেন, যদি আমার দল কখনো রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসে তখন আমি পরিবারটিকে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করব ইনশাআল্লাহ।
রিপন শীলের পরিবার জানায়, পরিবারের একমাত্র অবলম্বন ছিল রিপন শীল। সেলুন কর্মচারী হিসেবে চাকরি করে সংসার চালাত। এখন পরিবারটি অসহায় হয়ে পড়েছে। বাবা রতন চন্দ্র শীলও অসুস্থ শয্যাশায়ী অবস্থায় আছেন। তার ছোটভাই শিপন চন্দ্র শীলও (২০) এ দিনে আন্দোলনে গিয়ে আহত হয়। তার শরীরে অসংখ্য স্প্লিন্টার রয়েছে। যন্ত্রণায় মাঝে মাঝেই কাতরাচ্ছেন তিনি।