ছেলের ফলাফল শুনে অঝোরে কাঁদছেন মা
এটিএম সামসুজ্জোহা, ঠাকুরগাঁও
প্রকাশ: ১৬ অক্টোবর ২০২৪, ০৯:০৭ পিএম
গ্রামের সবার কাছে ভালো ছেলে হিসেবেই পরিচিত ছিলেন তিনি। ছাত্র হিসেবে ভালো ছিলেন আন্দোলনে শহিদ আবু রায়হান। তার মায়ের ইচ্ছা ছিল ছেলে ডাক্তার হয়ে মানুষের সেবা করবে। সঙ্গে শেষ বয়সে দেখভাল করবে বাবা-মায়ের কিন্তু তার সেই আশা অধরাই রয়ে গেল।
মঙ্গলবার প্রকাশিত এইচএসসি পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করলেও সেটি এখন মূল্যহীন সেই মায়ের কাছে। আনন্দের বদলে অঝোরে কাঁদছেন গত ৫ আগস্ট ছাত্র আন্দোলনে শহিদ আবু রায়হানের মা রাহেনা বেগম। কারণ এখন শুধু তার কাছে রয়ে গেছে ছেলের রেখে যাওয়া স্মৃতি।
মঙ্গলবার এইচএসসি (আলিম) পরীক্ষার ফলাফলে আবু রায়হান জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছেন। তিনি ঠাকুরগাঁ সদর উপজেলার রহিমানপুর আলিম মাদ্রাসা থেকে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছিলেন।
আবু রায়হানের পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত ৪ আগস্ট ছাত্র আন্দোলনে যান আবু রায়হান। ওই দিন পুলিশের ছররা গুলিতে আহত হয়ে বাড়িতে অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। পরদিন ৫ আগস্ট বিকালে ঠাকুরগাঁও রোড ছিট চিলারং এলাকায় সাবেক পৌর কাউন্সিলর একরামুদৌলার বাড়িতে একদল সঙ্গীদের সঙ্গে জান আবু রায়হান। সেখানে গ্যাস সিলিন্ডারের দেওয়া আগুনে ঝলসে গুরুতর আহত হন আবু রায়হানসহ চারজন। এরপর রংপুর থেকে ঢাকায় নেওয়ার পথে মারা যান তিনি।
এ ঘটনায় একে একে পুড়ে যাওয়া চারজনই মারা যান। ওই ঘটনায় আবু রায়হানের বাবা ফজলে আলম বাদী হয়ে ঠাকুরগাঁও-১ ও ২ আসনের সাবেক এমপিসহ ৯১ জনের নামে আদালতে মামলা করেন। ওই মামলায় ঠাকুরগাঁও-১ আসনের সাবেক এমপি রমেশ চন্দ্র সেন, ঠাকুরগাঁও-২ আসনের সাবেক এমপি মাজহারুল ইসলাম সুজন ও সুজনের বাবা সাবেক এমপি দবিরুল ইসলামকে জেলহাজতে পাঠানো হয়।
প্রতিবেশীরা জানান, রায়হান খুব ভালো ছেলে ছিলেন। তার জিপিএ-৫ পাওয়ায় খুশি তারা কিন্তু এই খুশির কোনো মূল্য নেই। ছেলে নেই। বের হয়েছে এইচএসসি পরীক্ষা ফলাফল। ভালো ফলাফল পেলেও সন্তানহীন বাড়িতে নেই আনন্দের আভাস।
রায়হানের এক সহপাঠী বলেন, আমরা ছোটবেলা থেকে একসঙ্গে বড় হয়েছি, একসঙ্গে পড়াশোনা করেছি, ঘুরেছি। কখনও সে খারাপ আচরণ করেনি। এখন সে আমাদের মাঝে নেই।
আবু রায়হানের মা রাহেনা বেগম বলেন, ৪ আগস্ট আন্দোলনে গিয়েছিল রায়হান। ওই দিন ওর শরীরে একটা গুলিও লেগেছিল। সেই দিনের কিছু ভিডিও মোবাইলে নিয়ে এসেছিল। আমরা জানতাম না ওর গুলি লেগেছে। রাতে ও খুব অসুস্থ হয়ে পড়ে।
রাহেনা বেগম বলেন, আমার কিন্তু একটাই ছেলে। খুব আদরের সন্তান রায়হান। ৫ আগস্ট বললাম, বাবা খারাপ লাগছে। ও বলল– না মা। এভাবে সে সারা দিন বাসায় ছিল। বিকালে আমাদের এলাকার আশপাশের ছেলেরা রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল, ওইটা দেখার জন্য রায়হানও যায়। সাহেব কমিশনারের ওখানে আরও কয়েকজন ছেলে যায়। পাশাপাশি সেও (রায়হান) যায়। আমি শুনেছি ওইখানে নাকি সিলিন্ডার সেট করা ছিল এবং মুখগুলো খুলে রাখা ছিল। মুখ খোলার পর ওরাই (কমিশনারের লোকজন) আগুন দিয়ে দেয়। আগুনে সে পুড়ে যায়। এরপর ঠাকুরগাঁও নিয়ে গেল, সেখান থেকে রংপুর নিয়ে গেল, রংপুর থেকে ঢাকায়। সেখানে ছিল পাঁচ দিন। তারপর আমার বাবুটা আর নাই।’
ছেলেকে নিয়ে প্রত্যাশার কথা জানিয়ে রাহেনা বেগম বলেন, কত যে আশা ছিল এই ছেলেটাকে নিয়ে। সে মানুষের মতো মানুষ হবে, মানুষের সেবা করবে। একটাই ছেলে আমার, আর ওর বাবা অসুস্থ, আমরা তো প্রায় অচল হয়ে গেছি। আমাদের কে দেখাশোনা করবে! ওই ছেলেটা আমাদের অবলম্বন ছিল। ছেলেটা বড় হয়ে চাকরি করবে, আমাদের দেখবে, কিন্তু....। আমাদের এখন কে দেখবে? এই কথা বলে কান্নায় ভেঙে পড়েন রাহেনা বেগম।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, মঙ্গলবার রেজাল্ট বের হইছে। এত বড় একটা রেজাল্ট পাইছে, জিপিএ-৫ পাইছে। কত যে খুশি হইতো ছেলেটা আমার। এখন আনন্দের বদলে শুধু কান্না পাচ্ছে। আমি চাই না আর কোনো মায়ের কোল এভাবে খালি হোক। যে সন্তান হারিয়েছে সেই বুঝতে পারবেন, তারাই এ কষ্ট বুঝতে পারবে।