সরকারি বরাদ্দ লুটে যেভাবে বিপুল সম্পদের মালিক এমপি মোস্তাফিজ

শহীদুল্লাহ শাহরিয়ার, চট্টগ্রাম
প্রকাশ: ১৬ অক্টোবর ২০২৪, ০৬:২৫ পিএম

সরকারি বরাদ্দ লুট করে বিপুল সম্পদের মালিক হন চট্টগ্রাম-১৬ (বাঁশখালী) আসনের সাবেক এমপি মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী। টিআর-কাবিখাসহ সরকারি প্রকল্পের কোটি কোটি টাকা লুটপাট করেছেন তিনি। এভাবে ১০ বছরের ব্যবধানে তার সম্পদের পরিমাণ বাড়ে ১৪ গুণ।
২০১৪ সালে প্রথমবার ও ২০১৮ সালে দ্বিতীয় বার কখনো দিনের ভোট রাতে নিয়ে কখনও বিনা ভোটের এমপি হয়ে আগ্রাসী রূপে আবির্ভূত হন মোস্তাফিজুর রহমান। দলের ভেতরে-বাইরে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়লেও তৃতীয় দফায় ২০২৪ সালেও তিনি আওয়ামী লীগের নৌকার মনোনয়ন পান।
যদিও ওই নির্বাচনে তার প্রতিপক্ষ স্বতন্ত্র প্রার্থী মুজিবুর রহমান জয়ী হন। এরপর থেকে এলাকায় তাকে তেমন দেখা যায়নি। তবে ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর থেকে এক সময়ের প্রতাপশালী এই এমপি আত্মগোপনে চলে যান।
বাঁশখালীতে শুধু এক (২০১৪-১৫) অর্থবছরের সরকারি বরাদ্দ বণ্টনের হাল ঘাঁটতে গিয়ে পুকুরচুরির তথ্য পাওয়া যায়। দেখা গেছে, বাঁশখালীর কাথারিয়া হালিয়াপাড়া দুর্গামন্দিরের নামে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য সোলার প্যানেলের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ২৫ হাজার টাকা। অথচ সেখানে কোন দুর্গা মন্দিরেরই অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। একই বছর সোলার প্যানেল স্থাপন করতে গন্ডামারা মনাজি পুকুরপাড় জামে মসজিদের জন্য ২৫ হাজার টাকা এবং শীলকূপ ইকোপার্ক মসজিদের জন্য ৪০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়।
এ দুই মসজিদেই কোনো সোলার প্যানেল স্থাপিত হয়নি। একই অর্থবছরে গ্রামীণ অবকাঠামো সংস্কার (কাবিখা) ও গ্রামীণ অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ (টিআর, বিশেষ টিআর) কর্মসূচির আওতায় বিভিন্ন পর্যায়ে গম, চাল এবং টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। ওই অর্থবছরে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্যায়ে বাঁশখালীতে বরাদ্দ দেওয়া হয় ৪০৯ টন চাল, ১৪৬ টন গম এবং ১ কোটি ২৭ লাখ ৮৬ হাজার ১৩৪ টাকা।
এর মধ্যে বিদ্যুৎ সংকট মোকাবিলায় টিআর-কাবিখা কর্মসূচির আওতায় সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যে সোলার প্যানেল স্থাপনের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয় ৩০ লাখ ৮০ হাজার টাকা। যার সিংহভাগই লোপাট হয়েছে বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের। এলাকাবাসীর মতে, মসজিদ, মন্দির বা কোনো প্রতিষ্ঠানে সোলার প্যানেল স্থাপন করা হয়েছে কী হয়নি তা দৃশ্যমান। আর এ কারণেই এ খাতে বরাদ্দের অর্থ কাজে লাগানো হয়েছে কিনা-তা সহজেই প্রমাণ করা যাচ্ছে। কিন্তু রাস্তাঘাট সংস্কার বা অবকাঠামো উন্নয়নের বিভিন্ন প্রকল্প কতটুকু বাস্তবায়ন হয়েছে বা আদৌ বাস্তবায়ন হয়েছে কিনা তা প্রমাণ করা দুরূহ।
যদিও তাদের অভিযোগ, মসজিদ-মন্দির ও সংস্থা বা সংগঠন সংস্কার, রাস্তাঘাটের উন্নয়নসহ নামে-বেনামে প্রকল্প দেখিয়ে বরাদ্দের একটি বড় অংশ লোপাট করা হয়েছে। ওই মেয়াদে বাঁশখালীতে ৬০০ কোটি টাকার উন্নয়ন কাজ হয়েছে বলে কাগজে-কলমে দেখানো হয়েছে। শুধু বেড়িবাঁধ নির্মাণে ২৫১ কোটি টাকা খরচ হয়েছে।
সূত্র জানান, বাঁশখালীতে ১০ বছর এমপি থাকাকালে মোস্তাফিজুর রহমান টিআর-কাবিখা, সড়ক অবকাঠামো উন্নয়নে সরকার যে শত শত কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে তার সিংহভাগ লোপাট করা হয়। সবচে বেশি লোপাট হয়েছে সৌরবিদ্যুৎ প্যানেল স্থাপনে। টিআর-কাবিখা কর্মসূচির আওতায় বরাদ্দের অর্থ কোথায় কীভাবে বিতরণ করা হয়েছে, সে বিষয়ে অনুসন্ধান করতে গিয়ে বেরিয়ে আসে সৌরবিদ্যুৎসহ বিভিন্ন প্রকল্পে অর্থ লোপাটের ভয়াবহ চিত্র।
মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী এবং জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা আবুল বাশার স্বাক্ষরিত একটি বরাদ্দ তালিকা যুগান্তরের হাতে এসেছে। এ তালিকায় দেখা গেছে, গণ্ডামারা ১ নম্বর ওয়ার্ড বঙ্গবন্ধু পরিষদ সংস্কারের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয় ২০ হাজার টাকা। অথচ এখানে বঙ্গবন্ধু পরিষদ বা এ নামের কোনো সংগঠনের কার্যালয়ই নেই। তালিকায় বা কাগজে-কলমে এসব বরাদ্দ দেখানো হলেও প্রকৃত অর্থে এসব প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে কোনো বরাদ্দই দেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের।
গণ্ডামারা ১ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার মোহাম্মদ ফেরদৌস জানান, গণ্ডামারা মনাজিপুকুরপাড় জামে মসজিদে এমপির পক্ষ থেকে কোনো সোলার প্যানেল বা টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। একইভাবে খাজা গরিবে নেওয়াজ রেয়াজুল জান্নাত মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি জমির উদ্দিন চিশতি, দিদারিয়া মাদ্রাসার পরিচালক মাওলানা হাফেজ ইসহাক, গণ্ডামারায় ফয়জুল উলুম মাদ্রাসার মোহতামিম মাওলানা জহিরুল ইসলাম ও ইউসুফ আলী ফোরকানিয়া মাদ্রাসার শিক্ষক মাওলানা হাবিবুর রহমান অভিযোগ করেছেন তাদের প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে সোলার প্যানেল স্থাপনের জন্য কোনো বরাদ্দ পাননি।
জানা গেছে, এমপি হওয়ার আগে প্রভাতী ইন্স্যুরেন্স নামের একটি কোম্পানিতে মহাব্যবস্থাপক পদে চাকরি করতেন মোস্তাফিজ। এমপি হওয়ার পর গত ১০ বছরে তার সম্পদ বেড়েছে ১৪ গুণ। তার স্ত্রীর সম্পদও বেড়েছে চারগুণ। সরকারি বরাদ্দ লুটপাট, কমিটি বাণিজ্যসহ নানাভাবে লুটপাট করে তিনি বনেছেন টাকার কুমির। হাঁকিয়ে বেড়ান দেড় কোটি টাকার প্রাডো জিপ ও ল্যান্ডক্রুজার। নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া সম্পদের হলফনামা অনুযায়ী মোস্তাফিজুর রহমান ২০১৪ সালে ১১ লাখ ৬৬ হাজার ১৮৪ টাকার মালিক ছিলেন।
২০২১-২২ অর্থবছরে জমা দেওয়া আয়কর নথিতে মোস্তাফিজ ১ কোটি ৬৭ লাখ ২২ হাজার টাকার সম্পদ রয়েছে বলে উল্লেখ করেন। রাজউকে প্লট বাগানোর বাইরেও নামে-বেনামে তিনি বিপুল সম্পদের মালিক বনেছেন বলে দলীয় সূত্রগুলো জানিয়েছে।