তিনি একই সঙ্গে পোস্টমাস্টার-অধ্যক্ষ-কাজী
গাজীপুর প্রতিনিধি
প্রকাশ: ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১০:৪৮ পিএম
অধ্যক্ষ, পোস্টমাস্টার, নিকাহ রেজিস্ট্রার, ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর পরিমাপকারী একই ব্যক্তি। সরকারি এই চারটি পদের সুবিধাভোগী সৌভাগ্যবান ব্যক্তিটির নাম মোবারক হোসেন। শুধু তাই নয়, স্ত্রী ও মেয়েও তার সহকর্মী, সহোদর ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সভাপতি।
আলোচিত ওই অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে ১৪ দফা অনিয়ম-দুর্নীতি তুলে ধরে গাজীপুরের জেলা প্রশাসকের কাছে লিখিত অভিযোগ করেছেন একজন অভিভাবক।
জেলা প্রশাসকের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, জেলার কাপাসিয়া উপজেলার পাকিয়াব গ্রামের মৃত ইয়াকুব আলীর ছেলে মোবারক হোসেন নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে একসঙ্গে পাকিয়াব সুমাইয়া ইসলামিয়া আলিম মাদ্রাসার অধ্যক্ষ, পাকিয়াব পোস্ট অফিসের পোস্টমাস্টার, কড়িহাতা ইউনিয়নের নিকাহ রেজিস্ট্রার (কাজী), এলাকার ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর পরিমাপকারী হিসেবে পৃথক চারটি পদের সরকারি সুবিধা ভোগ করছেন।
স্থানীয় কোড্ডাইদ গ্রামের মামুন জেলা প্রশাসকের কাছে লিখিত অভিযোগে জানান, অধ্যক্ষ মোবারক হোসেন সকাল ১০টায় লুঙ্গি পরে মাদ্রাসায় আসেন, আবার বেলা ১১টায় চলে যান। এরপর তার স্ত্রী মাদ্রাসার সহকারী শিক্ষিকা শাহিনুর বেগম বেলা ১১টায় ক্লাশ নিতে আসেন, আধঘণ্টা পর সাড়ে ১১টায় চলে যান। মোজাব্বিদ (ক্বারি) পদে তার স্ত্রীকে নিয়োগ দেওয়া হলেও তার ক্বারিয়ানার সনদ নাই।
নিয়োগ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হয়েও জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে প্রভাষক পদে নিয়োগ পেয়েছেন অধ্যক্ষের মেয়ে মাহমুদা নাছরিন। ওই নিয়োগ পরীক্ষায় নরসিংদীর একজন প্রার্থীকে নিয়োগ কমিটি মনোনীত করলেও তা গোপন রাখেন অধ্যক্ষ।
মেয়ে মাহমুদা নাসরিনকে নন-এমপিও হিসেবে আলিমে (উচ্চ মাধ্যমিকে) ইংরেজি বিষয়ের প্রভাষক পদে নিয়োগ দেওয়া হলেও বেতন উত্তোলন করেন এমপিওভুক্ত সহকারী মৌলভি পদের। তার বিরুদ্ধে সনদ জালিয়াতিরও অভিযোগ রয়েছে।
তাকে এমপিওভুক্ত করা হয়েছে মাহমুদা খাতুন নামে, অথচ সনদে তার নাম মাহমুদা নাসরিন। মাহমুদা রাজধানীর উত্তরায় স্বামী সংসার নিয়ে ব্যস্ত থাকায় ক্লাশ নেওয়ার সুযোগ পান না। বিগত ২০১৪ সালে নিয়োগ লাভের পর একদিনও ক্লাশে আসেন না বলে অভিযোগ শিক্ষার্থীদের।
তবে সরকার পরিবর্তনের পর সম্প্রতি মাঝে মাঝে তিনি ক্লাশ নিতে আসেন। এভাবে ১৪ বছর তিনি ক্লাশে না এসেও নিয়মিত বেতন ভাতা ভোগ করছেন। একইভাবে আলিমে (উচ্চ মাধ্যমিকে) নন-এমপিও শিক্ষক হিসেবে বাংলা বিষয়ের প্রভাষক পদে নিয়োগ পান সেলিম মোল্লা। তিনিও দাখিল (মাধ্যমিক) পর্যায়ে এমপিওভুক্ত হয়ে সহকারী শিক্ষক পদের সরকারি সুবিধা ভোগ করছেন। তার বিরুদ্ধেও সনদ জালিয়াতির অভিযোগ রয়েছে।
শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদপত্রে তার নাম সেলিম মোল্লা, আর এমপিওভুক্ত হয়েছেন সেলিম মিয়া নামে। পত্রিকায় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ ছাড়াই ১০ লাখ টাকার ঘুসের বিনিময়ে ফেরদৌসী আক্তারকে সহকারী শিক্ষক পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে বলেও অভিযোগ উঠে।
উল্লেখিত তিন শিক্ষকের কারো এনটিআরসিএ নিবন্ধন নাই, বিএড প্রশিক্ষণ নাই। অথচ তারা বিএড প্রশিক্ষণের জাল সনদে উচ্চতর বেতন ভাতার সুবিধা নিচ্ছেন।
সরকারি বিধি লঙ্ঘন করে মাদ্রাসার প্রথম শ্রেণির পরীক্ষার ফি ১২০ টাকা থেকে পর্যায়ক্রমে দশম শ্রেণিতে ৭০০ টাকা প্রতি পরীক্ষার্থীর কাছ থেকে নেওয়া হয়। দাখিল ও আলিমে রেজিস্ট্রেশন বাবদ প্রত্যেক শিক্ষার্থীর কাছ থেকে নেওয়া হয় দেড় হাজার টাকা। এছাড়া দাখিলে ফরম ফিলাপে চার হাজার এবং আলিমে পাঁচ হাজার টাকা করে আদায় করা হয়। এ দুটি পরীক্ষার সনদ বিতরণের সময় প্রত্যেকের কাছ থেকে নেওয়া হয় দশ হাজার টাকা করে। এসব অর্থ একাই ভোগ করেন অধ্যক্ষ। মাদ্রাসার আয়-ব্যয়ের তথ্য অন্য কাউকে জানতে দেন না।
এভাবে প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে একটি ট্রাস্টি বোর্ডের মাধ্যমে মাদ্রাসা পরিচালিত হয়ে আসছে। প্রতিষ্ঠালগ্নে ট্রাস্টিবোর্ডের সভাপতি ছিলেন অধ্যক্ষের বড় ভাই নূরুল ইসলাম। তার মৃত্যুর পর অপর সহোদর মনিরুজ্জামান সভাপতি পদে স্থলাভিসিক্ত হয়েছেন। তার বিরুদ্ধেও মনগড়াভাবে মাদ্রাসা পরিচালনার অভিযোগ রয়েছে। ফলে উক্ত ট্রাস্টের কমিটি বাদ দিয়ে অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মতো সবার সমন্বয়ে গঠিত গভর্নিং বডি দিয়ে মাদ্রাসাটি পরিচালনার দাবি অভিভাবকদের।
এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে অধ্যক্ষ মোবারক হোসেন বলেন, অধ্যক্ষ ছাড়া অন্যান্য পদে আমি অবৈতনিক দায়িত্ব পালন করছি। পোস্ট অফিস আমাদের নিজস্ব জায়গায়। প্রথম থেকেই আমি এর দেখাশোনা করে আসছি। এছাড়া বাকি অভিযোগগুলো মিথ্যা। তদন্ত করলেই তার প্রমাণ পেয়ে যাবেন।