Logo
Logo
×

সারাদেশ

কলেজ দখলে মরিয়া জামায়াত নেতা যা বললেন

Icon

এমএ কাউসার, চট্টগ্রাম

প্রকাশ: ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০২:৩২ পিএম

কলেজ দখলে মরিয়া জামায়াত নেতা যা বললেন

চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী হাজেরা-তজু ডিগ্রি কলেজ দখলে নিতে মরিয়া হয়ে উঠেছে জামায়াতে ইসলামী সংশ্লিষ্ট একটি গ্রুপ। ওই গ্রুপটি ইতোমধ্যে বহিরাগতদের নিয়ে কলেজে দফায় দফায় নৈরাজ্য সৃষ্টির পাশাপাশি কলেজের উপাধ্যক্ষ এসএম আইয়ুবকে জোর করে পদত্যাগে বাধ্য করেছে।

ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষকে দিয়ে তিন শিক্ষকের বরখাস্ত আদেশ স্বাক্ষর করে নিয়েছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য একটি অ্যাডহক কমিটি অনুমোদন করলেও সেটিকে পাশ কাটিয়ে নতুন একটি অ্যাডহক কমিটি দেওয়া হয়েছে।

কলেজ কর্তৃপক্ষ অভিযোগ করেছে, ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পরই মূলত কলেজের জামায়াতপন্থি কিছু শিক্ষক নগর জামায়াতের সাংগঠনিক সম্পাদক মোহাম্মদ শামসুজ্জামান হেলালীকে নিয়ে দল পাকিয়ে পুরো কলেজের লেখাপড়ার পরিবেশ বিনষ্ট করার চক্রান্তে মেতেছে। এ ক্ষেত্রে তারা চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার নূরুল্লাহ নুরীর সমর্থন পাচ্ছেন বলেও কর্তৃপক্ষ অভিযোগ করেছে।

কলেজে দফায় দফায় নৈরাজ্য ও জোরপূর্বক অবৈধ কমিটিতে স্বাক্ষর নেওয়াসহ নানা কারণে পদত্যাগ করেছেন কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ চয়ন দাশ। সরকারের পট পরিবর্তনের পর দেশের সব কলেজের গভর্নিং বডি ভেঙে দিয়ে অ্যাডহক কমিটি গঠনের নির্দেশনা প্রদান করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। সে অনুযায়ী হাজেরা-তজু ডিগ্রি কলেজের কমিটি ভেঙে দিয়ে নতুন একটি অ্যাডহক কমিটি প্রস্তাব করে পাঠানো হয় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে।

গত ১১ সেপ্টেম্বর এ কমিটি অনুমোদন করেন জাতীয় বিশ্বিবিদ্যালয়ের উপাচার্য। এ কমিটির সভাপতি করা হয় মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসাইনকে। সদস্য সচিব হন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ চয়ন দাশ। ফেরদৌস বশীরকে বিদ্যোৎসাহী সদস্য, মুজিবুর রহমানকে দাতা সদস্য এবং নির্বাচনের মাধ্যমে সর্বোচ্চ ভোট পেয়ে রিফাত আরা শিক্ষক প্রতিনিধি নির্বাচিত হন। কিন্তু দেখা গেছে, এ কমিটি বহাল থাকা অবস্থায় চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার কলেজের অ্যাডহক কমিটির সভাপতি করেন চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার নূরুল্লাহ নূরীকে।

তিনি নতুন পৃথক একটি অ্যাডহক কমিটির প্রস্তাব করে তার এবং ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ চয়ন দাসের যৌথ স্বাক্ষরে মঙ্গলবার জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপচার্য বরাবর পাঠান। দেখা গেছে, এতে নগর জামায়াতের সাংগঠনিক সম্পাদক মোহাম্মদ শামসুজ্জামান হেলালীকে বিদ্যোৎসাহী সদস্য হিসাবে প্রস্তাব করা হয়েছে। কলেজের প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্য থেকে কারও নাম দেওয়া হয়নি।

চয়ন দাশ অভিযোগ করেছেন, নতুন অ্যাডহক কমিটির যে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে তাতে তার কোনো সম্মতি ছিল না। তার কাছ থেকে জোর করে স্বাক্ষর নেওয়া হয়েছে। এ চাপাচাপির কারণে তিনি ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ৩৪ বছরের পুরোনো প্রতিষ্ঠান হাজেরা-তজু ডিগ্রি কলেজ। এটি নগরীর চান্দগাঁও থানার চান্দগাঁওয়ে অবস্থিত। এ কলেজে ৫ হাজারের মতো শিক্ষার্থী রয়েছে। শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী রয়েছেন শতাধিক। নগরীতে রাজনীতিমুক্ত প্রতিষ্ঠান হিসাবেই বেসরকারি এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি পরিচিত। শিক্ষানুরাগী, সাবেক মন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসি ব্যক্তিগত অর্থায়নে ও উদ্যোগে চট্টগ্রামে যে ৪০টির মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন হাজেরা-তজু ডিগ্রি কলেজ তার অন্যতম।

বিশাল ক্যাম্পাসের সব জমি ভবন তাদের অর্থায়নে হয়েছে। সরকারের তরফ থেকে একটি একাডেমিক ভবন দেওয়া হয়েছে। ১২ জনের মতো শিক্ষককে দেওয়া হয় এমপিও। অন্যদের বেতন ও আনুষঙ্গিক খরচ কলেজের আয় থেকে, ঘাটতি থাকলে তা বিএসসি পরিবার থেকে দেওয়া হয়।

কলেজ কর্তৃপক্ষ অভিযোগ করেছে, ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর থেকে এ কলেজে অস্থিরতা তৈরির অপচেষ্টা চালিয়ে আসছিল একটি পক্ষ। কখনো বৈষম্যবিরোধী, কখনো এলাকার বাসিন্দা হিসাবে দাপট দেখিয়ে ক্যাম্পাসে ঢুকে তারা দাবি-দাওয়ার নামে প্রতিষ্ঠান অচল করার চেষ্টা চালায়। বেতন কমানো ও কিছু শিক্ষকের পদত্যাগ দাবি জানিয়ে আসছিল। তাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে কলেজের মাসিক বেতন কমানো হয়। কিন্তু এরপরও মঙ্গলবার দুপুর ১২টার দিকে বহিরাগতরা ক্যাম্পাসে ঢুকে অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষের কক্ষে গিয়ে অরাজকতা শুরু করে। মাইকে ঘোষণা দিয়ে উপাধ্যক্ষকে পদত্যাগের জন্য চাপ সৃষ্টি করে।

একপর্যায়ে চারদিক থেকে ঘিরে ধরে জোর করে উপাধ্যক্ষ এসএম আইয়ুবকে পদত্যাগপত্রে সই করতে বাধ্য করা হয়। এ সময় পেছন থেকে একজন তাকে ছুরি দিয়ে ভয় দেখায়। একপর্যায়ে উপাধ্যক্ষ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। পরে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের হাতে তিন শিক্ষকের নাম সংবলিত একটি বরখাস্ত আদেশের কপি ধরিয়ে দিয়ে সেটিতেও স্বাক্ষর নেওয়া হয়। যে তিন শিক্ষককে বরখাস্ত করতে বাধ্য করা হয়েছে তারা হলেন মো. দবির উদ্দিন, মোহাম্মদ কুতুব উদ্দিন ও একেএম ইসমাইল।

বৃহস্পতিবার চয়ন দাশ স্বাক্ষরিত শিক্ষা উপদেষ্টার কাছে পাঠানো চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, বুধবার চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার নুরুল্লাহ নূরী হাজেরা-তজু কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ চয়ন দাশকে তার কার্যালয়ে ডেকে পাঠান। তিনি অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনারের সঙ্গে দেখা করতে গেলে কার্যালয়ে আগে থেকেই হাজেরা-তজু কলেজের কিছু উচ্ছৃঙ্খল শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের দেখতে পান। সেখানে অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনারকে সভাপতি এবং জামায়াতের একজন নেতাকে (বিদ্যোৎসাহী) সদস্য করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় বরাবর পাঠানোর জন্য জোরপূর্বক তার কাছ থেকে (চয়ন দাশের) স্বাক্ষর নেওয়া হয়। এই স্বাক্ষরে তার কোনো মতামত ছিল না বলে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়।

অভিযোগে জামায়াতে ইসলামী চট্টগ্রাম মহানগরের সাংগঠনিক সম্পাদক মুহাম্মদ শামসুজ্জামান হেলালী যুগান্তরকে বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে সেখানে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে। এ কারণে কলেজটির শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের প্রস্তাবে অ্যাডহক কমিটিতে থাকতে রাজি হয়েছি। তবে এ বিষয়ে এখনো আনুষ্ঠানিক কোনো কাগজপত্র পাইনি।’

কলেজ দখলের প্রশ্নই উঠে না জানিয়ে শামসুজ্জামান হেলালী বলেন, ‘আমি কখনো হাজেরা-তজু কলেজের আশপাশেও যাইনি। তা ছাড়া কলেজের গভর্নিং বডির সদস্য হলে কি কলেজ দখল করা যায়? যারা এ ধরনের অভিযোগ করছেন সেটা তাদের হীন মনমানসিকতা। তাদের ভয়, আমি যদি সেখানে যাই তাহলে তাদের থলের বিড়াল বেরিয়ে আসবে। এ কারণেই তারা বিষয়টিকে ভিন্ন খাতে নিয়ে যাওয়ার অপচেষ্টা চালাচ্ছে বলে মনে করছি।’ সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও বিএনপি নেতা মাহবুবুল আলম যুগান্তরকে বলেন, ‘শুল্কবহর এলাকা থেকে গিয়ে জামায়াত নেতা হেলালী কলেজটির কর্তৃত্ব নিতে চাইছেন। আমি এ বিষয়ে প্রশাসনকে জানিয়েছি।’

চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার ও বিভাগীয় কমিশনার ঘোষিত পৃথক অ্যাডহক কমিটির সভাপতি নুরুল্লাহ নূরী যুগান্তরকে বলেন, বিভাগীয় কমিশনারের সঙ্গে পরামর্শ করে কলেজের অ্যাডহক কমিটি গঠন করার নির্দেশনা ছিল। কিন্তু তা না করে কলেজ কর্তৃপক্ষ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একটি কমিটি নিয়ে এসেছে। এটা ঠিক হয়নি।

তিনি বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দখল করার কারও সুযোগ নেই। ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ যাদের নাম প্রস্তাব করে নিয়ে এসেছেন আমি তাদের নাম দিয়ে কমিটি পাঠিয়েছি। অ্যাডহক কমিটি হলেও আমি দ্রুত সময়ে নির্বাচনের মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের ব্যবস্থা করব।’ 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম