চুরির অভিযোগে একজনকে গাছে বেঁধে প্রকাশ্যে পিটিয়ে হত্যা
দিনাজপুর প্রতিনিধি
প্রকাশ: ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৬:২৬ পিএম
ছবি: সংগৃহীত
মাছ ধরার জাল ও বিদ্যুতের তার চুরির অভিযোগে দিনাজপুরে তৌহিদুর রহমান নামে এক ট্রাক্টরচালককে প্রকাশ্যে গাছে বেঁধে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যাক্তিকে হারিয়ে দরিদ্র ওই পরিবারে শোকের মাতম চলছে। মিথ্যা অভিযোগে নিষ্ঠুরভাবে হত্যার ঘটনায় দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছে বিক্ষুব্ধ এলাকাবাসী। পুলিশ জানিয়েছে, আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণসহ দোষীদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।
নিহত তৌহিদুর রহমান দিনাজপুর সদর উপজেলার ৫নং শশরা ইউনিয়নের কাউগা সাহেবগঞ্জ জঙ্গলপাড়া গ্রামের মৃত মেহরাব আলীর ছেলে। পেশায় তিনি একজন ট্রাক্টরচালক। তবে প্রায় সময় হোটেল শ্রমিকের কাজও করতেন। গত শুক্রবার (২৭ সেপ্টেম্বর) জুমআর নামাজের পরে স্থানীয় সাহেবগঞ্জ বাজারে একটি খাবার হোটেলে কর্মরত অবস্থায় তাকে ডেকে নিয়ে মারপিট করা হলে বিকেলে তার মৃত্যু হয়।
শনিবার (২৮ সেপ্টেম্বর) সকাল ১০টায় তৌহিদুরের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় শোকের মাতম।
পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যাক্তিকে হারিয়ে বিলাপ করছেন তার দৃষ্টি প্রতিবন্ধী বৃদ্ধা মা তহমিনা বেগম। সন্তানের শোকে মাঝে মাঝে মুর্ছাও যাচ্ছেন।
মা বিলাপ করছেন আর বলছেন- ‘ছেলেটা দোকানত কাজ করোছিলো, সেইখান থাকি ডাকি নি যায় হাত-পা বান্ধিয়া চোখের সামনত আমার ছেলেটাক ডাঙ্গে মারি ফেলাইলো। কতবার নিষেধ করনু। জেলখানাত দিবার কনু, কাথায় শুনিল নাই। এলা আমাক কায় দেখিবি।’
তৌহিদুরের বাড়ি ঘুরে দেখা যায়, আত্রাই নদীর বাঁধের নিচে টিনের চালাযুক্ত একটি দুই কক্ষের বাড়ি। এখানেই প্রতিবন্ধী মা (এক চোখ নেই, কানেও শুনেন না) ও এক সন্তানকে নিয়ে বসবাস করেন বাংড়ু। বড় ছেলে ঢাকায় পোশাক কারখানায় কাজ করেন। স্ত্রী তাদের ছেড়ে চলে গেছেন। তৌহিদুরের লাশ তখনো মর্গ থেকে আনা হয়নি। প্রতবেশী ও স্বজনরা বাড়িতে অপেক্ষা করছেন। নিহত তৌহিদুরের মাকে সান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
বাংড়ুর মা তহমিনা বেগম জানান, শুক্রবার সকালে বাড়ি থেকে কাজের উদ্দেশ্যে বের হয় বাংড়ু। দুপুরে জানতে পারেন তার ছেলেকে পাশের পাড়ার জাহাঙ্গীর ও তার জামাই রেললাইনের ধারে খুঁটিতে বেঁধে মারপিট করছে। দ্রুত ঘটনাস্থলে যান তিনি। সেখানে গিয়ে ছেলেকে মারধর না করতে অনুরোধ করেন। মারপিটের এক পর্যায়ে বাংড়ুর শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে তাকে ফেলে চলে যায় মারধরকারীরা। তহমিনা বেগম স্থানীয় এক যুবকের সহযোগিতায় ছেলেকে বাড়িতে নিয়ে আসেন দুপুর ৩টায়। বাড়িতে আনার অল্প সময় পরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন তৌহিদুর রহমান।
প্রত্যক্ষদর্শীদের কয়েকজন জানান, দুইদিন আগে স্থানীয় জাহাঙ্গীর হোসেনের মাছ ধরা জাল ও স্যালো পাম্পের তার চুরি হয়েছিল। চোর সন্দেহে তৌহিদুরকে সাহেবগঞ্জ বাজারে হোটেল থেকে সকাল নয়টায় ডেকে নিয়ে যায় চুনিয়াপাড়ায়। সেখানে জাহাঙ্গীর হোসেনের জামাই জহুরুল ইসলাম মারধর করেন। পরে সেখান থেকে মালিবাসা আম বাগানে নিয়ে মারধর করেন। এরইমধ্যে ঘটনাস্থলে আরও দুইজন এসে মারধর করে বাড়ির পাশে রেললাইনের ধারে আনেন। সেখানেও মারধর করা হয় তৌহিদুরকে।
এলাকাবাসী তৌহিদুরকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যার বিচার ও হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন।
প্রতিবেশী শরিফা খাতুন বলেন, তৌহিদুর কখনও ট্রাক্টরের ড্রাইভারি এবং কখনও হোটেলে কাজ করে কষ্টে সংসার চালান। কিন্তু কখনই চুরি করার মতো কাজ সে করে নাই। তার মতো ছেলে চুরি করতেই পারে না। কিন্তু মিথ্যা অভিযোগে তাকে এভাবে নির্মমভাবে মেরে ফেলা হলো-এটা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। নির্মম এই হত্যার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন তিনি।
দিনাজপুর কোতয়ালী থানার ওসি মো. ফরিদ হোসেন জানান, শুক্রবার বিকেলে ঘটনা জানতে পেরে লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য দিনাজপুর এম আব্দুর রহিম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। নিহতের গায়ে বিভিন্ন জায়গায় মারধরের চিহ্ন পাওয়া গেছে। চোর সন্দেহে তাকে মারধর করা হয়েছে। এ ঘটনায় রাতেই নিহতের মামাতো ভাই শাহিনুর ইসলাম বাদি হয়ে ৫ জনের নাম উল্লেখ করে ও কয়েকজনকে অজ্ঞাতনামা দেখিয়ে একটি হত্যা মামলা করেছেন।