সাবেক এমপি ছলিম উদ্দীনের বাড়ি-গাড়ি-জমি-মার্কেট-ফ্ল্যাটের ছড়াছড়ি
মহাদেবপুর (নওগাঁ) প্রতিনিধি
প্রকাশ: ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১০:৪০ পিএম
নওগাঁ-৩ মহাদেবপুর-বদলগাছী আসনের সাবেক এমপি ছলিম উদ্দীন তরফদার সেলিম নানা অপকর্মের মাধ্যমে অবৈধভাবে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছেন। তিনি এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর মহাদেবপুর ও বদলগাছী উপজেলায় গড়ে তোলেন অবৈধ ঠিকাদারি সিন্ডিকেট, খাস পুকুর ও জমি দখল, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ বাণিজ্য, ইউপি নির্বাচনে চেয়ারম্যান-মেম্বার পদে দলীয় মনোনয়ন বাণিজ্য, সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বালুমহল ইজারা নিয়ে কোটি কোটি টাকার সম্পদের পাহাড় গড়েছেন।
তিনি তার সংসদীয় আসন মহাদেবপুর-বদলগাছী ছাড়াও নজিপুর (পত্নীতলা), নওগাঁ, রাজশাহী ও ঢাকায় জমি-বাড়ি কিনে গড়েছেন বিপুল সম্পদের পাহাড়।
ছলিম উদ্দীন তরফদার ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী (স্বতন্ত্র) এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর বিগত ১০ বছরে শুধুমাত্র মহাদেবপুরেই তার নিজের ও পরিবারের সদস্যদের নামে কয়েকশ কোটি টাকা মূল্যের একশটিরও অধিক দলিল রেজিস্ট্রি করেন।
এছাড়াও গড়েছেন ইটভাটা, কৃষিজমি, পুকুর, বাড়ি-গাড়ি ও মার্কেট। এসব সম্পদের মূল্য কয়েক হাজার কোটি টাকা। এমন দাবি খোদ আওয়ামী লীগ নেতাদের।
উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক পদে থেকে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়ে তৎকালীন এমপি ড. আকরাম হোসেন চৌধুরীকে পরাজিত করে স্বতন্ত্র এমপি হিসেবে নির্বাচিত হন তিনি। এরপর থেকেই শুরু হয় তার এই অস্বাভাবিক উত্থান। এরপর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়নে নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করে আবারও এমপি নির্বাচিত হন এবং বর্তমানে তিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন।
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ছলিম উদ্দীন তরফদার এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর তার ছেলে ও ভাগ্নের দল এলাকায় শুরু করে দখলদারিত্বের রাজত্ব। নামে-বেনামে সে সময় কয়েকশ একর খাস পুকুর ছিল তাদের দখলে। সরকারকে রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে এসব পুকুর দখল করে মাছ চাষ করে কামিয়েছেন কোটি কোটি টাকা।
এছাড়াও ক্ষমতার প্রভাব খাঁটিয়ে বিভিন্ন ঠিকাদারি কাজ যেমন, স্কুল-কলেজ বিল্ডিং, রাস্তা-ঘাট, ড্রেন-কালভার্ট, বিভিন্ন ভবন ও মার্কেট নির্মাণসহ এলাকায় সকল ঠিকাদারি কাজ করার একছত্র অধিকার ছিল শুধু তাদেরই। এসব কাজের অধিকাংশেই ব্যবহার করা হতো নিম্নমানের নির্মাণ সামগ্রী।
সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের যোগসাজশে নিম্নমানের নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহারের ব্যাপারে তাদের বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ থাকলেও ভয়ে মুখ খোলার সাহস পাননি কেউ।
ছলিম উদ্দীন তরফদার সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় নিজের পেশা চাল কল ব্যবসা, মৎস্য চাষ ও কৃষি উল্লেখ করলেও মূলত তার ব্যবসা ছিল মৎস্যচাষ ও ব্রয়লার।
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দেওয়া হলফনামায় তিনি যে পরিমাণ সম্পদের বিবরণ দিয়েছিলেন, বিগত ১০ বছরে তার সে সম্পদের পরিমাণ বেড়ে হয়েছে কয়েকশগুণ। কৃষি ও অকৃষি জমি থেকে শুরু করে বাড়ি-গাড়ি, ভবন, মার্কেটসহ বিপুল পরিমাণ সম্পদের পাহাড় গড়েছেন নামে-বেনামে।
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে হলফনামায় তিনি বিভিন্ন খাত থেকে বার্ষিক আয় দেখিয়েছিলেন ৪ লাখ ৪১ হাজার ৯৬২ টাকা এবং ইউপি চেয়ারম্যান হিসেবে ভাতা বাবদ ৪২ হাজার টাকা। এছাড়াও নিজ নামে নগদ ১ লাখ ২০ হাজার টাকা, স্ত্রীর ১০ হাজার টাকা, আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমা ছিল ৩ লাখ ১০ হাজার টাকা, স্ত্রীর নামে ১ লাখ ৯০ হাজার টাকা, বাস-ট্রাক বা মোটরগাড়ি ইত্যাদির মূল্য ১৪ লাখ ১০ হাজার টাকা, স্ত্রীর ২০ ভরি গহনার মূল্য ৯ লাখ টাকা। স্থাবর সম্পদ হিসেবে ২০.৯৮ একর কৃষিজমি, নওগাঁ পৌরসভায় সাড়ে ১৫ শতক জমির মূল্য ৪ লাখ ৬০ হাজার টাকা, চৌমাসিয়া মৌজায় ৪৫ শতক জমির মূল্য ৬ লাখ টাকা, ব্যক্তি মালিকানায় ৭টি পুকুরের মূল্য ৭ লাখ টাকা দেখানো হয়েছিল। এছাড়াও দুটি ব্যাংকে হিসেবে ১ কোটি ১০ লাখ ৩০ হাজার টাকা ঋণ হিসেবে দেখান সে সময়। সর্বোচ্চ শিক্ষাগত যোগ্যতার ঘরে লিখেছিলেন এসএসসি পাশ।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ছলিম উদ্দীন তরফদার যে হলফনামা নির্বাচন কমিশনে দাখিল করেছিলেন, সেখানে তিনি পৈতৃক সূত্রে প্রাপ্ত কৃষি জমির পরিমাণ উল্লেখ করেছিলেন ২০.৯৮ একর, যার মূল্য ৬৩ লাখ টাকা, স্ত্রীর নামে ৫ একর, যার মূল্য ২০ লাখ টাকা এবং নির্ভরশীলদের নামে ১ একর, যার মূল্য ৬ লাখ টাকা, অকৃষি জমির পরিমাণ দেখিয়েছিলেন ৬.১০ একর, যার মূল্য ২০ লাখ টাকা, স্ত্রীর নামে ২ একর, যার মূল্য ৬ লাখ টাকা, নিজ গ্রাম আজিপুরে পৈতৃক বাড়ি ছাড়াও উপজেলা সদরে একটি দালান বাড়ির মূল্য দেখানো হয়েছিল ১ কোটি ৭০ লাখ টাকা।
সর্বোচ্চ শিক্ষাগত যোগ্যতার ঘরে লিখেছিলেন এইচএসসি পাশ। অর্থাৎ তিনি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর এইচএসসি পাশ করেন। তার এ শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ছিল সাধারণ জনতাসহ খোদ আওয়ামী লীগ নেতাদের। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতা জানান, তার বদলে এসব পরীক্ষায় অংশ নিয়ে খাতায় লিখে দিয়েছিলেন অন্যজনেরা।
ওই হলফনামায় ছলিম উদ্দীন তরফদার তার পেশা দেখিয়েছিলেন, ‘চাল কল ব্যবসা, মৎস্য চাষ ও জোতদারি। এসব খাতের মধ্যে কৃষি খাতে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা, বাড়ি, দোকান ও অন্যান্য ভাড়া ১ লাখ ২০ হাজার টাকা, চাউল কল ব্যবসা ও মৎস্য খামার হতে ৩০ লাখ টাকা, শেয়ার সঞ্চয় থেকে ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা, অন্যান্য উৎস হতে (সংসদ সদস্য হিসেবে বেতন ভাতা) ৬ লাখ ৬০ হাজার টাকা এবং নির্ভরশীলদের ৭০ হাজার টাকা বার্ষিক আয় দেখিয়েছিলেন।
এছাড়াও অস্থাবর সম্পদ হিসেবে নগদ ২ লাখ টাকা, ব্যাংকে জমা ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা, একটি জীপ গাড়ির মূল্য ৫৫ লাখ টাকা, গৃহ সামগ্রীর মূল্য বাবদ ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা ও অন্যান্য ১ লাখ ৭৫ হাজার টাকার অস্থাবর সম্পদ এবং স্ত্রীর নগদ ৬০ হাজার টাকা, ব্যাংকে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা ও ২৫ ভরি স্বর্ণের গহনা বাবদ ১২ লাখ টাকার হিসেব দেখানো হয়।
২০১৮ সালের নির্বাচনে ছলিম উদ্দীন তরফদারের হলফনামায় দেওয়া সম্পদের তথ্য কাল্পনিক উল্লেখ করে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা বলেন, তিনি তার দেওয়া হলফনামায় অনেক সম্পদের তথ্য গোপন করায় তার প্রকৃত সম্পদের হিসাব পাওয়া যায়নি। প্রকৃতপক্ষে এই ১০ বছরে তার সম্পদ বেড়েছে কয়েকশগুণ।
সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এমপি নির্বাচিত হওয়ার পরপরই নওগাঁর শহরের প্রাণকেন্দ্র গোস্তহাটির মোড়ের সন্নিকটে এক বিঘা জমির উপর একটি বারোতলা ‘টাইম স্কয়ার’ নামে বাণিজ্যিক ও আবাসিক ভবন নির্মাণ করেন। উপজেলা সদরের কলেজ রোডে দেড় কোটি টাকারও অধিক মূল্য দিয়ে ৩ তলা একটি বাড়ি ক্রয় করলেও হলফনামায় বাড়িটির মূল্য দেখানো হয়েছে মাত্র ৩০ লাখ টাকা। পরে এটিকে ৫ তলা দৃষ্টিনন্দন ‘নক্ষত্র বাড়ি’তে রূপান্তর করতে আরও ১ কোটি টাকার অধিক টাকা খরচ করেছেন। এছাড়াও গ্রামে ১টি ইটভাটা নির্মাণসহ কয়েকশ বিঘা কৃষিজমির মালিক হয়েছেন।
মহাদেবপুর-বদলগাছী উপজেলার বিশাল বিশাল খাস পুকুর, দীঘি নামে-বেনামে লিজ নিয়ে ও লিজ ছাড়া দখল করে মাছ চাষ করেছেন। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বচনের মাত্র কয়েক দিন আগে অবৈধভাবে তার দখলকৃত হাতুড় বিল নামে প্রায় ২৮ বিঘার একটি পুকুর তার থেকে দখলমুক্ত করে সরকার লিজের আওতায় নিয়ে আসে।
এ আসনের প্রায় ৮০ ভাগ ঠিকাদারি কাজ তার ছেলে ও ভাগ্নেরা করেছে, সেসব কাজের এখন পর্যন্ত অসমাপ্ত রয়েছে অনেক। বাইরের কোন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এসব কাজ করতে চাইলে ক্ষমতার দাপট ও ভয়-ভীতি দেখিয়ে সেসব কাজও করেছে তার ছেলে ও ভাগ্নের দল। পারিবারিক গণ্ডগোল বা বিতর্কিত জমি নামমাত্র মূলে নামে-বেনামে কিনে ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে দখল করে নেওয়ার জন্য ছিল তার বিশাল বাহিনী।
সম্প্রতি উপজেলা সদরের অজয় গোপাল ব্যানার্জীর (কেনা মাস্টারের) তার শরিকের প্রায় ১ বিঘা অর্পিত সম্পত্তি দখলে থাকা অবস্থায় ছলিম উদ্দীন তরফদারের ছেলে ও ভাগ্নের দল ওই বিশাল বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে জোরপূর্বক দখল করে গাছপালা কেটে স্থাপনা নির্মাণ করেন এবং এসব জমি কোনো বৈধ কাগজপত্র ছাড়াই বিভিন্ন জনের কাছে বিক্রি করে দিয়েছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
ছলিম উদ্দীন তরফদার এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর দুই উপজেলায় বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ দিয়ে কয়েকশ কোটি টাকার নিয়োগ বাণিজ্য করেছেন। প্রতিটি বিদ্যালয়ে ৩য় বা ৪র্থ শ্রেণির কর্মচারী নিয়োগ দিতে ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকা করে হাতিয়ে নিয়েছেন। এছাড়াও প্রধান শিক্ষক বা সহকারী প্রধান শিক্ষক নিয়োগের জন্য প্রত্যেকের কাছ থেকে ২০ থেকে ৩০ লাখ টাকা করে হাতিয়ে নিয়েছেন।