৫ আগস্টের পর রাতারাতি বিএনপি নেতা
রামগতিতে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছেন ডাকাত ফরিদ
শাহরিয়ার কামাল, কমলনগর (লক্ষ্মীপুর) প্রতিনিধি
প্রকাশ: ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০২:৫৮ পিএম
অভিযুক্ত ডাকাত শেখ ফরিদ। ছবি : সংগৃহীত
লক্ষ্মীপুরের রামগতি ও নোয়াখালীর হাতিয়ার চর এলাকায় ডাকাত ফরিদকে চেনেন না এমন মানুষ নেই। এতোদিন হাতিয়ায় আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি মোহাম্মদ আলীর ছত্রছায়ায় অপরাধ জগতের নিয়ন্ত্রণ ছিল তার হাতে। ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর ভোল পাল্টে ফরিদ বিএনপি নেতা বনে গেছেন রাতারাতি।
অভিযোগ রয়েছে, গত ৫০ দিনে রামগতির বয়ারচরের ব্রিজঘাট তেগাছিয়া ও টাংকিরঘাট এলাকায় মাছঘাট দখল, মুক্তিপণ আদায়, অপহরণ, ডাকাতি, লুটপাট করে অন্তত দুই কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে ফরিদ। এছাড়া তার বাহিনী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নামেও নির্বিঘ্নে তুলছে চাঁদা। ফরিদের ক্ষমতার কাছে স্থানীয় তেগাছিয়া ও টাংকিরঘাট এলাকার দুটি পুলিশ ফাঁড়ি এখন ডাকাতদের রান্নাঘরে পরিণত হয়েছে।
জানা যায়, স্বৈরাচার হাসিনার পতনের পর রামগতির চরগাজী ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মো. সাইফুল ইসলাম ও হাতিয়া বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য ফজলুল আজিমের সমর্থক হরনী ইউনিয়ন বিএনপির স্থানীয় কতিপয় নেতার আশ্রয়-প্রশ্রয়ে বিএনপির নাম ভাঙিয়ে চাঁদাবাজি, নারী নির্যাতন, মেঘনা নদীতে ডাকাতি ও অপহরণের এক রাজত্ব কায়েম করে ফরিদ। এসব অপকর্মের সহযোগী হিসেবে রয়েছে তার ৫ ভাইসহ অন্তত ৪০ জন ডাকাত। তাদের সবার হাতে রয়েছে অবৈধ আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র। বর্তমানে ফরিদের ভয়ে আ. লীগের সব নেতাকর্মী এলাকাছাড়া।
সম্প্রতি ফরিদ ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে মো. জহির উদ্দীন বাদী হয়ে রামগতি থানা ও সেনা ক্যাম্পে পৃথক অভিযোগ দায়ের করেন।
অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, গত ৫ আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত বয়ারচরের টাংকিরঘাট, তেগাছিয়া ও ব্রিজঘাট এলাকার প্রায় ২ শতাধিক পরিবারের ওপর নির্মম নির্যাতন চালিয়েছে ফরিদ ও তার বাহিনী। এরমধ্যে টাংকিরঘাট এলাকায় তিনটি ধর্ষণের ঘটনা ঘটিয়েছে ফরিদের নেতৃত্বাধীন বাহিনী। তাদের হামলায় গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন অন্তত ৩০ জন।
এছাড়া অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করেছে—এমন ভুক্তভোগীর সংখ্যা ২০ জন। প্রত্যেকের কাছ থেকে ২ লাখ থেকে ৫ লাখ টাকা আদায় করা হয়েছে। জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে অন্তত ১৫ টি বসতবাড়ি। লুট করা হয়েছে তেগাছিয়া ব্রিজঘাট ও টাংকিরঘাটের প্রায় অর্ধশতাধিক দোকান।
অভিযোগপত্রে আরও উল্লেখ করা হয়, ৫ আগস্ট পুলিশ সদস্যরা সরে যাওয়ার পর ২ টি পুলিশ ফাঁড়িতে এখন ডাকাতদের রান্না-বান্নার কাজ চলছে। এসব অরাজকতার প্রধান হোতা ফরিদ বাহিনীর প্রধান ফরিদ ডাকাত।
নাম প্রকাশ না করা শর্তে এক ব্যক্তি জানান, চর জিয়াউদ্দিন গ্রামের শাহাদাতের বাড়িতে ঢুকে স্বামীকে গাছের সঙ্গে বেঁধে গৃহবধূকে ধর্ষণ করা হয়। এছাড়া ওই গ্রামের সুজন মেম্বারের বাড়ির বাবলু ও রিপনের স্ত্রীকে ধর্ষণ করে ফরিদের নেতৃত্বাধীন বাহিনী।
সেন্ট্রাল বাজার এলাকার নুরনবী জানান, তাকে অপহরণ করে নিয়ে গিয়ে ৫ লাখ টাকা দাবি করে ফরিদ বাহিনী। পরে মুক্তিপণ হিসাবে তার ব্যবহৃত একটি পার্লসার মটরসাইকেল ও নগদ এক লাখ টাকা দিয়ে ছাড়া পান।
একইভাবে বয়ারচরের গিয়াসউদ্দিন জানান, ফরিদ ডাকাত তার কাছে ৫ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করলে তিনি ২ লাখ ৭০ হাজার টাকা দিয়ে ছাড়া পেয়েছেন। আরেক ভুক্তভোগী সৈয়দ ব্যপারি জানান, তার কাছ থেকে ৩ লাখ টাকা নিয়েছে ফরিদ বাহিনীর লোকজন।
টাংকির ঘাটের বাবলু জানান, দাবি করা টাকা দিতে না পারায় তার বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে ফরিদ বাহিনী। তার মতো ওই এলাকায় অন্তত ১৫টি ঘরবাড়ি জ্বালিয়েছে ফরিদের ডাকাত বাহিনী।
এদিকে ফরিদের ভয়ে এলাকা ছাড়া মো. রহিজল, আলাউদ্দিন বেপারিসহ কয়েকজন বলেন, ফরিদ আমাদের কাছে মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করেছে।
তার দাবি করা টাকা দিতে না পারায় প্রাণের ভয়ে স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছি। ডাকাত ফরিদের বিচার দাবি করেন তারা।
সরেজমিন গেলে ভুক্তভোগীরা জানান, ফরিদ এর আগে আওয়ামী লীগ নেতা হাতিয়ার সাবেক এমপি মোহাম্মদ আলীর কুখ্যাত ডাকাত সর্দার খোকন ডাকাতের ছত্রছায়ায় ছিল। তবে গত ৫ আগস্ট রাতে অন্তত ২ শতাধিক অস্ত্রধারী ডাকাতকে হাতিয়া থেকে রামগতির বয়ারচরের তেগাছিয়া এলাকায় নিয়ে আসে ফরিদ।
তারা জানান, ওইদিন থেকে নিজেকে বিএনপির নেতা পরিচয় দিয়ে সাধারণ মানুষকে আ. লীগ ট্যাগ লাগিয়ে হামলা, ধর্ষণ, অপহরণ, ডাকাতি, জমি দখল, বসতবাড়ি দখল, মাছঘাট দখল ও মুক্তিপণ আদায় করছে। তার সঙ্গে আছে বাদশাহ, ভুট্টু, ফজলু, আলমগীর, হোসেন, মাকছুদ ও আওলাদসহ প্রায় দুইশ’ জন স্বীকৃত ডাকাত ।
ফরিদের নেতৃত্বে এসব ডাকাত বাহিনী রাতের আঁধারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নাম ভাঙিয়ে চাঁদা তুলছে। তাদের ভয়ে রামগতির বয়ারচরের ব্রিজঘাট, তেগাছিয়া ও টাংকির ঘাট এলাকায় চরম ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে বলে জানান তারা।
ব্রিজঘাট এলাকার এক ইউপি সদস্য জানান, ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর ফরিদ বাহিনীর লোকজন ওই সব এলাকার দোকানপাট, মাছের আড়ত, বসতবাড়ি ও জমি দখল করে অন্তত দুই কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। বিভিন্ন দোকান থেকে লুট করা হয়েছে অন্তত দেড় কোটি টাকার মালামাল। দখল করেছে বয়ারচরের টাংকির ঘাট ও ব্রিজঘাটের কোটি কোটি টাকার মাছ ধরার ট্রলার।
ডাকাত ফরিদের অন্যতম সহযোগী আলমগীর ব্যাপারীর নেতৃত্বে চারশ’ মাঝির কাছ থেকে বিএনপির নেতাদের নামে তোলা হচ্ছে ৩০০ টাকা করে চাঁদা। চাঁদাবাজি থেকে বাদ পড়েনি দরিদ্র জেলেরাও, প্রত্যেক জেলেকে দিতে হচ্ছে দৈনিক ৫০ টাকা করে চাঁদা।
অভিযুক্ত ফরিদ মোবাইল ফোনে বলেন, আমি কোনো অপকর্মের সঙ্গে জড়িত না। ৫ তারিখের পর বাচ্চু চেয়ারম্যানরা ব্যাপক তাণ্ডব চালিয়ে আমার অফিসও ভাঙচুর করছে। তাই বাচ্চু চেয়ারম্যানের অপকর্ম প্রতিহত করছি আমরা। হাতিয়া ও সুবর্ণচরের লোকজন আমাদের বয়ারচরে তাণ্ডব চালাতে আসলে আমি জনগণকে সঙ্গে নিয়ে প্রতিহত করছি। এখন তো যৌথবাহিনীর অভিযান চলছে। এই সুযোগে তারা আমার বিরুদ্ধে বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগও দিচ্ছে।
বিএনপির নেতা মীর আক্তার হোসেন বাচ্চু বলেন, ফরিদের তাণ্ডবলীলায় গোটা বয়ারচর এখন এক আতঙ্কের নাম। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী না থাকায় একক আধিপত্য বিস্তার করে ফরিদ আলাদাভাবে শাসন করছে বিশাল এই চরে। এমন কোনো অপকর্ম নেই, যা ফরিদ ও তার বাহিনী করে না।
ফরিদের এসব কর্মকাণ্ডের বিষয়ে জানতে চাইলে রামগতি উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক ডা. জামাল উদ্দিন যুগান্তরকে জানান, ফরিদ বিএনপির কেউ নন। বিএনপির নাম ভাঙিয়ে চাঁদাবাজি করলে তাকে ধরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে সোপর্দ করা হবে। বিএনপিতে কোনো অপরাধীর জায়গা নেই।
হাতিয়ার সাবেক এমপি মোহাম্মদ আলী বর্তমানে কারাগারে থাকায় তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
রামগতি থানার ওসি মোহাম্মদ মোছলেহ উদ্দিন বলেন, দুর্গম বয়ারচরে ফরিদ বাহিনী শাসন করে বেপরোয়া তাণ্ডবলীলা চালানোর খবর আমরা প্রতিনিয়ত পাচ্ছি। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি। সেনাবাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ চলছে। অচিরেই যৌথবাহিনী বয়ারচরে অভিযান পরিচালনা করবে। আমরা সবকিছু প্রসেসিং করছি।