ছেলেদের নামে কলেজের অর্ধকোটি টাকার জমি লিখে দিয়েছেন অধ্যক্ষ
রাজশাহী ব্যুরো
প্রকাশ: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৭:৫৯ পিএম
রাজশাহীর মোহনপুর উপজেলার আত্রাই অগ্রণী ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ আরসুজ্জামান মালেকের বিরুদ্ধে উঠেছে ভয়াবহ জালিয়াতি, দুর্নীতি, অর্থ আত্মসাৎ আর অনিয়মের বিস্তর অভিযোগ। অধ্যক্ষ নাবালক নিজের দুই ছেলে এবং লাইব্রেরিয়ানের নামে বর্তমান বাজার মূল্যের অর্ধকোটি টাকার জমি লিখে দিয়েছেন।
সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পড়াশোনা না করলেও বিধিবিধানের তোয়াক্কা না করে ছেলেকে অন্য বিষয়ে দিয়েছেন শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ।
কলেজে চাকরি না করেও দুই শিক্ষকের নামে বেতন উত্তোলন করে হাতিয়ে নিয়েছেন মোটা অংকের টাকা।
একই ইনডেক্সে অবৈধভাবে একাধিক শিক্ষক ও কর্মচারীর বেতন উত্তোলন, শিক্ষক-কর্মচারীদের পদোন্নতি এবং প্যাটার্নবহির্ভূত শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে নিয়েছেন বিপুল পরিমাণ অর্থ। বেশিদিন চাকরি করার জন্য অধ্যক্ষ দুটি জন্ম তারিখ ব্যবহার করেছেন।
এসব অনিয়ম আর দুর্নীতির বিষয়ে প্রতিকার চেয়ে কলেজটির সহকারী অধ্যাপক নাজমুল হক দেওয়ান গত ২০ আগস্ট রাজশাহীর জেলা প্রশাসক বরাবর অভিযোগ দিয়েছেন। অধ্যক্ষের দুর্নীতি এবং অনিয়ম সংক্রান্ত সব অভিযোগের প্রমাণ সংক্রান্ত নথি যুগান্তরের হাতে এসেছে।
এদিকে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের অভিযোগে অধ্যক্ষ আরসুজ্জামান মালেক একটি মামলার আসামি। গত ২ সেপ্টেম্বর মোহনপুর সদরের নাহিদ পারভেজ নামের এক ব্যক্তি এ মামলা করেন। মামলার আসামি হওয়ার পর থেকে অধ্যক্ষ গা-ঢাকা দিয়েছেন।
অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগের পর গত ২ সেপ্টেম্বর জেলা প্রশাসকের কার্যালয় বিষয়টি তদন্তের জন্য জ্যেষ্ঠ সহকারী কমিশনার শাহীন মিয়াকে দায়িত্ব দিয়েছে। তদন্ত শুরু হওয়ার পর গত ১৭ সেপ্টেম্বর অধ্যক্ষ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন।
জেলা প্রশাসক বরাবর অভিযোগপত্রের সঙ্গে জমি বিক্রির দলিল এবং নিরীক্ষা আপত্তির কাগজপত্রও সংযুক্ত করা হয়েছে। এতে দেখা গেছে, ২০০০ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর ছেলে মাহমদুজ্জামান এবং মাহবুবুজ্জামানের নামে কলেজের ৭৪ শতক জমি দলিল করে দিয়েছেন অধ্যক্ষ। বিক্রয় কবলা দলিলে জমির মূল্য ধরা হয়েছে দেড় লাখ টাকা।
শিক্ষকদের অভিযোগ, মূল্য দেখিয়ে এ জমি টাকা ছাড়াই ছেলেদের নামে লিখে দেন অধ্যক্ষ। দলিল করার সময় অধ্যক্ষের ছোট ছেলে মাহবুজ্জামান নাবালক ছিল বলেও শিক্ষকদের অভিযোগ। তাদের বক্তব্য, বর্তমানে এ জমির বাজার মূল্য প্রায় অর্ধকোটি টাকা।
কলেজটিতে ২০১৪ সালের ২ মার্চ নিরীক্ষা করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদফতর। পরে সংশ্লিষ্ট দফতরের উপপরিচালক দেবদুলাল ভট্টাচার্যের দেওয়া প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৭টি দলিলে কলেজের মোট জমির পরিমাণ দাবি করা হয় ২ দশমিক ৭৮ একর; কিন্তু নিরীক্ষায় দেখা যায়, মাত্র তিনটি দলিলে জমির পরিমাণ ১ দশমিক ২৫ একর।
প্রতিষ্ঠানের জমি বিক্রি করতে হলে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও শিক্ষা বোর্ডের অনুমোদন প্রয়োজন; কিন্তু কোনো অনুমোদন নেননি অধ্যক্ষ। এক্ষেত্রে অধ্যক্ষ কলেজ পরিচালনা পর্ষদের ওপর দায় চাপিয়ে বিষয়টি এড়ানোর চেষ্টা করেছেন। ওই প্রতিবেদনে সরকারি বিধিবিধান প্রতিপালন না করার জন্য সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশও করা হয়; কিন্তু তারপরও অধ্যক্ষ দীর্ঘ সময় দায়িত্ব পালন করেছেন।
অপরদিকে অভিযোগে বলা হয়, অধ্যক্ষ তার ছেলে মাহমুদুজ্জামানকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার ক্ষেত্রেও কোনো বিধিবিধানের তোয়াক্কা করেননি। মাহমুদুজ্জামান সমাজ বিজ্ঞানে পড়াশোনা করেছেন। কম্পিউটার সায়েন্সের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। আর ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিংয়ের শিক্ষক হিসেবে বেতন উত্তোলন করছেন।
অধ্যক্ষ আরসুজ্জামান জন্ম তারিখের ক্ষেত্রেও ভয়াবহ জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছেন। অভিযোগে বলা হয়েছে, তার জন্ম তারিখ দুটি। প্রথমবার তিনি ১৯৭৭ সালে এসএসসি পাস করেন। সেখানে তার জন্ম তারিখ ছিল ১৯৬০ সালের ১৫ অক্টোবর। এ অনুযায়ী ২০২০ সালেই তার অবসরে যাওয়ার কথা। তবে নিজের এবং পিতার নাম আংশিক পরিবর্তন করে ১৯৮২ সালে আবার এসএসসি পাস করেন। এসএসসির সর্বশেষ সার্টিফিকেটটি তিনি নিয়োগের সময় ব্যবহার করেন। মূলত বেশিদিন চাকরিতে থাকতে তিনি দুটি জন্ম তারিখ করেন। এভাবে তিনি বেশিদিন চাকরি করে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।
এছাড়া শামিমা ইসলাম এবং তসলিম উদ্দিন নামের দুই শিক্ষক কলেজে চাকরি করেননি। অথচ তাদের এমপিওভুক্ত করে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন অধ্যক্ষ। ঘটনাটি জানতে পেরে তসলিম উদ্দিন মোহনপুরের ইউএনওর কাছে লিখিত অভিযোগ দেন। এছাড়াও শিক্ষক-কর্মচারীদের পদোন্নতির জন্য অধ্যক্ষ অর্থবাণিজ্য করেছেন বলেও অভিযোগে বলা হয়েছে।
অভিযোগকারী শিক্ষক নাজমুল হক দেওয়ান বলেন, স্থানীয় বিদ্যানুরাগী মানুষ কলেজকে জমি দান করেছিলেন। সেই জমি ছেলেদের নামে লিখে দিয়েছেন অধ্যক্ষ। চাকরিবিধি লঙ্ঘন করে ছেলেকে চাকরি দিয়েছেন। তার অনিয়মের শেষ নেই। আমরা অধ্যক্ষের সব অপকর্মের সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত চাই। তার বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে জোর দাবি জানাচ্ছি।
অভিযোগ সম্পর্কে বক্তব্যের জন্য অধ্যক্ষ আরসাজ্জুমানের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করা হয়। মামলার আসামি হওয়ায় তিনি আত্মগোপনের থাকার কারণে ফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়। তার ছেলে ওই কলেজের শিক্ষক মাহমুদুজ্জামাানকে ফোন দিলে তিনিও ধরেননি। খুদে বার্তা (এসএমএস) পাঠিয়েও মেলেনি সাড়া।
অধ্যক্ষের অভিযোগের বিষয়ে তদন্তের দায়িত্বপ্রাপ্ত সহকারী কমিশনার শাহিন মিয়া বলেন, অভিযোগকারী এবং অধ্যক্ষকে আগামী বুধবার ডাকা হয়েছে। বিষয়টি তদন্তাধীন।
তবে অধ্যক্ষ মামলার আসামির কারণে আত্মগোপনে রয়েছেন- এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, এটি আমার জানা নেই। খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা নেব।