বগুড়ায় ১৯ সাংবাদিক আত্মগোপনে, পরিবারের মানবেতর জীবনযাপন
বগুড়া ব্যুরো
প্রকাশ: ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১০:৪০ পিএম
বগুড়ায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে পুলিশের গুলিতে দুজন নিহতের ঘটনায় পৃথক হত্যা মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে চার পেশাদার সাংবাদিককে আসামি করা হয়েছে। পাশাপাশি আরেক সাংবাদিকের বিরুদ্ধে সাইবার ট্রাইব্যুনালে মামলার আবেদন করা হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন উপজেলায় বিস্ফোরকসহ অন্যান্য ধারায় আরও ১৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে।
এ অবস্থায় গ্রেফতার ও হয়রানি এড়াতে ১৯ সাংবাদিক পরিবার ফেলে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। এতে একদিকে তাদের পেশা হুমকির মুখে পড়েছে; অন্যদিকে তাদের অনুপস্থিতিতে পরিবারের সদস্যরা মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
ভুক্তভোগীরা সুষ্ঠু তদন্তসাপেক্ষে সাংবাদিকদের এসব হয়রানিমূলক মামলা থেকে অব্যাহতি দিতে সরকারের জরুরি হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
হত্যা মামলায় আসামি করা সাংবাদিকরা হলেন- বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) সহ-সভাপতি, বগুড়া প্রেসক্লাবের সভাপতি ও দৈনিক জনকণ্ঠের স্টাফ রিপোর্টার মাহমুদুল আলম নয়ন, বিএফইউজের নির্বাহী সদস্য, অবজারভারের জেলা প্রতিনিধি বীর মুক্তিযোদ্ধা এএইচএম আখতারুজ্জামান, বগুড়া সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি ও দৈনিক কালেরকণ্ঠের বগুড়া জেলা প্রতিনিধি জেএম রউফ এবং ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশনের উত্তরাঞ্চলীয় প্রধান প্রবীণ সাংবাদিক হাসিবুর রহমান বিলু।
বিস্ফোরক আইনসহ বিভিন্ন ধারার আসামি হয়েছেন ১৪ সাংবাদিক। তারা হলেন- দৈনিক কালের কণ্ঠের নন্দীগ্রাম উপজেলা প্রতিনিধি ফিরোজ কামাল ফারুক, দৈনিক কালবেলার সারিয়াকান্দি প্রতিনিধি মঞ্জু মিয়া, যায়যায়দিনের শিবগঞ্জ প্রতিনিধি সোহেল আক্তার মিঠু, দৈনিক ইত্তেফাকের আদমদীঘি প্রতিনিধি আনোয়ার হোসেন, প্রতিদিনের বাংলাদেশের আদমদীঘি প্রতিনিধি জিআরএম শাহজাহান, ভোরের দর্পণের মোকামতলা প্রতিনিধি আপেল মাহমুদ, দৈনিক উত্তরের দর্পণের মোকামতলা প্রতিনিধি আবু জাফর ইকবাল, দৈনিক জয় যুগান্তরের মোকামতলা প্রতিনিধি হাসান আলী, দৈনিক চাঁদনী বাজারের আদমদীঘি প্রতিনিধি মিহির কুমার সরকার, দৈনিক চাঁদনী বাজারের সান্তাহার প্রতিনিধি মতিউর রহমান সাগর, দৈনিক ভোরের দর্পণের সোনাতলা প্রতিনিধি নিপুন আনোয়ার কাজল, দৈনিক প্রভাতের আলোর সোনাতলা প্রতিনিধি মাহমুদুর রশিদ সোহেল এবং দৈনিক ভোরের খবরের সোনাতলা প্রতিনিধি মোস্তাফিজার রহমান পিন্টু এবং দৈনিক করতোয়া নন্দীগ্রাম উপজেলা প্রতিনিধি ও উপজেলা প্রেসক্লাবের সভাপতি বকুল হোসেন। এছাড়া বিডিনিউজ টুয়েন্টিফোরডটকমের বগুড়ার স্টাফ রিপোর্টার জিয়া শাহীনের বিরুদ্ধে রাজশাহীর সাইবার ট্রাইব্যুনালে লিখিত অভিযোগ দেওয়া হয়েছে। তবে আদালত এখনো সেটির আদেশ দেননি।
পুলিশ ও এজাহার সূত্র জানায়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে গত ৪ আগস্ট বেলা সাড়ে ১১টার দিকে শহরের ঝাউতলা এলাকা থেকে সদর থানায় হামলা করা হয়। এ সময় গুলিতে শহরের দক্ষিণ বৃন্দাবনপাড়ার দর্জি মো. শিমুল নিহত হন। ২৭ আগস্ট রাতে নিহতের স্ত্রী শিমু বেগম সদর থানায় শেখ হাসিনা, ওবায়দুল কাদের ও আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক এমপি মজিবর রহমান মজনু ও রাগেবুল আহসান রিপু, সাংবাদিক হাসিবুর রহমান বিলু, মাহমুদুল আলম নয়ন এবং জেএম রউফসহ ১৩৫ জনের নাম উল্লেখ করে ৫৩৫ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন।
একই দিন ওই স্থানে রিপন ফকির নামে এক কসাই মিছিলে গিয়ে হৃদরোগে মারা যান। তার স্ত্রী মাবিয়া বেগম ১৭ সেপ্টেম্বর সদর থানায় শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা, সজীব ওয়াজেদ জয়, ওবায়দুল কাদের, সাংবাদিক এএইচএম আখতারুজ্জামানসহ ১০৪ জনের নাম উল্লেখ করে ৪০৪ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন।
অপরদিকে জেলার বিভিন্ন থানায় ১৪ সাংবাদিকের বিরুদ্ধে অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর, নাশকতা ও বিস্ফোরক আইনের বিভিন্ন ধারায় মামলা হয়েছে।
পাশাপাশি সাংবাদিক জিয়া শাহীনের বিরুদ্ধে রাজশাহী সাইবার ট্রাইব্যুনালে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন যায়যায়দিনের জেলা প্রতিনিধি ইমরান হোসেইন লিখন।
এদিকে ১৮ সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা ও একজনের নামে সাইবার ট্রাইব্যুবনালে অভিযোগ দেওয়ায় বগুড়ার পেশাজীবী সাংবাদিকদের মাঝে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে।
হত্যা মামলার আসামি চারজন সাংবাদিকের স্ত্রী-সন্তানরা জানান, থানা ও সরকারি বিভিন্ন স্থাপনায় হামলার সময় পুলিশের গুলিতে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারীরা নিহত হন। অথচ বিএনপি-জামায়াত নেতা এবং জনপ্রতিনিধিদের পরামর্শে করা মামলায় সাংবাদিকদের আসামি করা হয়। মামলার পর থেকে সাংবাদিকরা আত্মগোপন করায় পরিবারের সদস্যরা মানবেতর জীবনযাপন করছেন। এতে তাদের সংসার চলছে না।
কয়েকটি হত্যা মামলার বাদী ও তাদের পরিবারের সদস্যরা জানান, স্বজনরা হতাহত হওয়ায় তাদের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। তবে তারা স্থানীয় বিএনপি-জামায়াত ও জনপ্রতিনিধিদের পরামর্শে মামলাগুলো করেছেন। তারা মামলার অধিকাংশ আসামিদের চেনেন না। তারা শুধু এজাহারে স্বাক্ষর দিয়েছেন। অভিযোগ প্রমাণ করতে না পারলে উল্টো মামলার বিষয়টি নিয়ে তারাও উদ্বিগ্ন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন সাংবাদিক নেতা জানিয়েছেন, পেশাদার এসব সাংবাদিক কখনো অপরাধের সঙ্গে জড়িত নন। অথচ তাদের হত্যাসহ বিভিন্ন মামলায় জড়িয়ে হয়রানি করা হচ্ছে। তারা আত্মগোপন করায় পেশাগত দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হচ্ছেন। তাদের কর্মজীবন হুমকিতে পড়েছে। আর পরিবারের সদস্যরা মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন। দর্জি মো. শিমুল ও কসাই রিপন ফকির কাদের গুলিতে নিহত হয়েছেন, তা আমাদের জানা আছে। অথচ সাংবাদিকদের ওই হত্যা মামলায় আসামি করে হয়রানি করা হচ্ছে। এসব মিথ্যা মামলা থেকে অব্যাহতি দিতে সরকারের জরুরি হস্তক্ষেপ কামনা করছি আমরা।
বগুড়ার নবাগত পুলিশ সুপার জেদান আল মুসা জানান, মামলাগুলো তদন্ত করে আসামিদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে নিরাপরাধ কেউ যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সে ব্যাপারে নজর রাখা হচ্ছে।