Logo
Logo
×

সারাদেশ

ভিটেমাটি নেই, গুলিতে নিহত রাসেলের দাফন হয় চাচার জমিতে

Icon

নেত্রকোনা প্রতিনিধি

প্রকাশ: ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৭:৪০ পিএম

ভিটেমাটি নেই, গুলিতে নিহত রাসেলের দাফন হয় চাচার জমিতে

গাজীপুরের মাওনায় মোরগবাহী একটি ভ্যান গাড়িতে হেলপারের কাজ করতেন রাসেল মিয়া (১৯)। বৃদ্ধ বাবা-মায়ের ভরণপোষণের জন্য কিশোর বয়স থেকেই এ কাজে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। ৫ আগস্ট আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ছোঁড়া গুলিতে নিহত হন রাসেল। নিজেদের ভিটেমাটি না থাকায়, রাসেলের লাশ দাফন করা হয় তার চাচার জমিতে।

পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ছেলেকে হারিয়ে দিশেহারা রাসেলের বৃদ্ধ বাবা-মা। কীভাবে চলবে তাদের বাকি জীবন? কে দেখাশোনা করবে তাদের? তাদের খাবার, চিকিৎসা খরচ কে বহন করবে? ছেলেকে হারিয়ে দুশ্চিন্তায় দিন কাটছে তাদের। 

গত ৫ আগস্ট বিকালে গাজীপুর জেলার মাওনা চৌরাস্তা এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পোশাক পরা ভারতীয়দের আটক করে স্থানীয় লোকজন। এ খবর ছড়িয়ে পড়লে ভগ্নীপতির সঙ্গে সেখানে যান রাসেল মিয়া। ঘটনাস্থলের কাছাকাছি যেতেই গুলি ছোঁড়ে আইনশৃ্খ বাহিনী। ওই সময় একটি বুলেট রাসেলের মাথার একপাশ দিয়ে ঢুকে অন্যপাশ দিয়ে বের হয়ে যায়। 

মুহূর্তেই রাস্তায় লুটিয়ে পড়েন রাসেল। পাশে থাকা ভগ্নীপতি শামীম মিয়াসহ আশপাশের লোকজন তাকে উদ্ধার করে পাশের হাসপাতালে নিয়ে যান। অবস্থা গুরুতর হওয়ায় রাসেলকে দ্রুত নিয়ে যাওয়া হয় ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ (মমেক) হাসপাতালে। পরে সেখানে রাত ১১টার দিকে তার মৃত্যু হয়। 

রাতেই লাশ নিয়ে যাওয়া হয় গ্রামের বাড়ি নেত্রকোনার বারহাট্টা উপজেলার বাউসী ইউনিয়নের সুসং ডহরপাড়া গ্রামে। নিজেদের জায়গা জমি না থাকায় পরদিন সকালে জানাজা শেষে রাসেলের লাশ তার চাচার জায়গায় দাফন করা হয়। 

নিহত রাসেল বারহাট্টা উপজেলার সুসং ডহরপাড়া গ্রামের মুন্সি মিয়ার ছেলে। দুই ভাই এক বোনের মধ্যে সবার ছোট ছিলেন রাসেল। 

গ্রামের বাড়িতে ভিটে মাটির জায়গাটুকুও নেই মুন্সি মিয়ার। তাই রোজগারের জন্য এক যুগ আগে গাজীপুরের মাওনা এলাকায় চলে যান পরিবার নিয়ে। সেখানে গিয়ে মুন্সি মিয়া দিনমজুরি শুরু করেন। তার স্ত্রী শ্রমিকদের সহকারীর (জোগালি) কাজ করে সংসারের খরচ যোগান। তবে ছোট ছেলে রাসেলের জন্মের পর মুন্সি মিয়া মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েন। এতে তার রোজগার বন্ধ হয়ে যায়। এর মধ্যে মেয়েকে বিয়ে দেন। আর বড় ছেলে বিয়ের পর মাওনায় আলাদা বসবাস শুরু করেন। কাজও করেন মাওনার একটি কারখানায়। 

মুন্সি মিয়ার মেয়ের স্বামী মোরগবাহী গাড়ির চালক শামীম মিয়া। পরিবার চালাতে তাই বাধ্য হয়ে কিশোর বয়সেই ভগ্নিপতি শামীমের গাড়িতে হেলপারের কাজ নেন রাসেল। রোজ ৬০০ টাকা বেতনে বাবা-মাকে নিয়ে ভালোই চলছিল তাদের সংসার। 

নিহত রাসেল মিয়ার ভগ্নীপতি শামীম মিয়ার (৩০) বাড়ি ময়মনসিংহের ত্রিশালে। গাজীপুরের মাওনা চৌরাস্তা এলাকায় থাকেন তিনিও। 

শামীম মিয়া বলেন, রাসেলের বড় ভাই কাওছার বিয়ের পর সংসার নিয়ে আলাদা হয়ে গেছেন। তাই বাবা-মায়ের দেখাশোনা ও ভরণপোষণের ভার রাসেলের ওপর পড়ে। ৫-৬ বছর ধরে আমার গাড়িতে হেলপার (সহকারী) হিসেবে কাজ করে আসছিল রাসেল। ৫ আগস্ট বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে মাওনা চৌরাস্তা এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পোশাকে ভারতীয় বাহিনীর লোকজনকে ছাত্রজনতা ঘিরে রেখেছে- এমন খবর শুনে রাসেল আর আমি দেখতে যাই। কাছাকাছি যেতেই গুলি ছোঁড়া হয়। গুলি খেয়ে অসংখ্য মানুষ রাস্তায় লুটিয়ে পড়তে থাকে। অনেকের মতো রাসেলও লুটিয়ে পড়ে। কিছুটা শান্ত হলে দৌড়ে গিয়ে রাসেলকে উদ্ধার করি। একটি গুলি তার মাথার একপাশে লেগে অপরপাশ দিয়ে বের হয়ে যায়। 

তিনি বলেন, দ্রুত তাকে পাশের একটি হাসপাতালে নিয়ে যাই। অবস্থা গুরুতর দেখে উন্নত চিকিৎসার জন্য ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠান চিকিৎসক। তখন একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশা ভাড়া করে মমেক হাসপাতালে রওনা হই। মমেকে নিয়ে চিকিৎসা শুরু করা হলে রাত ১১টার দিকে মৃত্যু হয় রাসেলের। রাতেই লাশ নিয়ে গ্রামের বাড়ি রওনা হই। পরদিন সকালে জানাজা শেষে দাফন করা হয়। যেহেতু গ্রামে রাসেলদের কোনো ভিটেমাটি নেই, তাই তার চাচার জায়গাতেই দাফন করা হয়।

শামীম মিয়া বলেন, রাসেলের রোজগারেই তার বাবা-মার খাওয়া দাওয়া চিকিৎসাসহ সব ভরণপোষণ চলত। রাসেল নেই, তাদের দেখাশোনার আর কেউ রইল না। এখন আমি তাদেরকে দেখাশোনা করছি। নিজেও গরীব মানুষ কষ্ট করে চলি। আল্লাহই একমাত্র রিজিকের মালিক।

এদিকে বারহাট্টা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রাসেলের পরিবারকে ৫০ হাজার টাকা সহায়তা দিয়েছেন। জেলা বিএনপির আহ্বায়ক ডা. আনোয়ার হোসেন ১০ হাজার টাকা আর্থিক সহায়তা দিয়েছেন বলেও জানান তিনি। 

রাসেলের গ্রামের বাসিন্দা মনোয়ার হোসেন বলেন, রাসেলের বাবা মুন্সি মিয়া ভূমিহীন। অভাবের তাড়নায় এক যুগেরও বেশি আগে পরিবার নিয়ে গাজীপুরে চলে যান তিনি। সেখানে শ্রমিকের কাজ করে সংসার চালাচ্ছিলেন। বাবা-মায়ের একমাত্র অবলম্বন ছিল রাসেল। তার মৃত্যুতে পরিবারটি মহাবিপদে পড়ে গেল।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম