তুলে নেওয়ার সাত বছর পরও ফেরেননি তারা, গুম তদন্ত কমিশনে অভিযোগ
রাজশাহী ব্যুরো
প্রকাশ: ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০১:৫৭ পিএম
গুম হওয়া কুদ্দুশ।
রাজশাহীর বাগমারার বিভিন্ন এলাকা থেকে সাত বছর আগে তিনজনকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। কিন্তু গত সাত বছরে তারা কেউই আর ফিরে আসেননি। গত বৃহস্পতিবার ভুক্তভোগী পরিবারগুলো গুম তদন্ত কমিশনে অভিযোগ জমা দিয়েছেন। গুম হওয়া ব্যক্তিদের ফিরে আসার আশায় নতুন করে বুক বেধেছেন ভুক্তভোগীদের পরিবার।
রাজশাহীর বাগমারা উপজেলার মাড়িয়া ইউনিয়নের কাঁঠালবাড়ি গ্রামের স্কুল শিক্ষক মরহুম আব্দুস সামাদের স্ত্রী আবেদা বিবি প্রতিদিন বাড়ির দরজার সামনে বসে থেকে পথের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকেন। সাত বছর আগে হঠাৎ হারিয়ে যাওয়া সন্তানের ফেরার অপেক্ষার পালা যেন আর শেষ হয় না মায়ের। সাত বছর আগে হাটে যাওয়ার জন্য বাড়ি থেকে বের হয়ে পথেই নিখোঁজ হয়ে যান কুদ্দুশ। আর ফিরে আসেনি আবেদা বিবির একমাত্র ছেলে।
জানা গেছে, ২০১৭ সালে ২০ দিনের ব্যবধানে রাজশাহীর বাগমারা থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় কুদ্দুশসহ তিন ব্যক্তিকে। গত সাত বছরেও তারা আর ফেরেনি। ওই সময় বাগমারা থানায় সাধারণ ডায়েরি হলেও নিখোঁজ ব্যক্তিদের উদ্ধারে কোনো তৎপরতা দেখায়নি পুলিশ। র্যাব কার্যালয়ে বারবার ধর্ণা দিয়েও কোন সাড়া পায়নি ভুক্তভোগীদের পরিবার।
এসব গুমের ঘটনায় গত ৯ সেপ্টেম্বর নতুন করে থানায় অভিযোগ দেওয়া হলেও অভিযোগগুলি মামলা হিসেবে রেকর্ড করা হয়নি। পুলিশ কর্মকর্তারা ভুক্তভোগী পরিবারগুলিকে জানিয়েছে, গুম কমিশন হওয়ায় গুমের এসব ঘটনা কমিশনে জানাতে। কমিশন আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করবে।
রাজশাহী জেলা পুলিশের মুখপাত্র ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রফিকুল ইসলাম বলেন, গুমের ঘটনা তদন্তে বিশেষ কমিশন গঠন করা হয়েছে। অভিযোগুলো এখন কমিশনই তদন্ত করবেন। কমিশনের প্রতিবেদনে যে নির্দেশনা আসবে সে অনুসারে কাজ করবে পুলিশ। এ কারণে তাদের অভিযোগ মামলা হিসেবে রেকর্ড করা হয়নি। কমিশনের কাছে তাদের কাগজপত্র জমা দিতে বলা হয়েছে।
ভুক্তভোগী পরিবারগুলো গতকাল বৃহস্পতিবার ঢাকায় গুম তদন্ত কমিশনে অভিযোগ জমা দিয়েছেন বলে জানা গেছে।
গুম হওয়া আব্দুল কুদ্দুশের মা আবেদা বিবির অভিযোগে জানা গেছে, আমার ছেলে আব্দুল কুদ্দুশ ২০১৭ সালের ৬ এপ্রিল বিকালে দেড় লাখ টাকা নিয়ে গরু কেনার জন্য পাশ্ববর্তী নওগাঁ জেলার আত্রাই উপজেলার আহসানগঞ্জ হাটে যাচ্ছিল। সঙ্গে ছিলেন কুদ্দুশের চাচা আসকেন আলী, প্রতিবেশী আমিনুল ও রুহুল আমিন। একটা রিকসা ভ্যানে করে হাটে যাওয়ার পথে বারইহাটি মোড়ে পৌঁছালে দু’টি মোটরসাইকেলে চারজন তাদের পথরোধ করে। তারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোক পরিচয় দেন। বিপদ বুঝতে পেরে কুদ্দুশ পাশের একটি পুকুরে ঝাঁপ দেন। আগন্তকরা পুকুর থেকে টেনে তুলে কুদ্দুশকে মোটরসাইকেলে মাঝখানে তুলে নিয়ে চলে যায় হাতকড়া পরিয়ে। এরপর আর বাড়িতে ফেরেনি কুদ্দুশ। ঘটনার দেড় বছর পর ২০১৮ সালের অক্টোবরের কোন একদিন বোনের স্বামী মমতাজ উদ্দিনের নম্বরে ফোন আসে।
কুদ্দুশ ভগ্নিপতিকে জানায়, সে বন্দী অবস্থায় আছে। তাকে নির্যাতন করে আটকে রাখা হয়েছে। এরপর আর কোনদিন কেউ যোগাযোগ করেনি। থানায় সাধারণ ডায়েরি করা হলেও পুলিশ কোন তৎপরতা দেখায়নি।
গুম হওয়া আব্দুল কুদ্দুসের মা আবেদা বিবি আরও বলেন, আমার চার মেয়ে ও এক ছেলে। ছেলেটা পুকুর লিজ নিয়ে মাছ চাষ ও বাড়িতে গরুর খামার করেছিল। হঠাৎই সে নিখোঁজ হয়ে গেলো। ছেলেটা আর আসল না। ছেলের শোকে আমার স্বামী অসুস্থ হয়ে ২০১৮ সালের ২২ ডিসেম্বর মারা যান।
কুদ্দুশের ছোট বোন পারভিন জানান, ভাইয়ের খোঁজে অনেক জায়গায় গিয়েছি। কেউ কোন সহযোগীতা করেনি। বৃহস্পতিবার আমরা গুম তদন্ত কমিশনে অভিযোগ জমা দিয়েছি।
এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আব্দুল কুদ্দুশকে তুলে নেওয়ার ছয়দিন আগে ২০১৭ সালের ৩০ মার্চ বাগমারা উপজেলার হামিরকুৎসা গ্রামের আরেক আব্দুল কুদ্দুশকে (৪২) একইভাবে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। পরিবারের সদস্যরা পুলিশসহ বিভিন্ন স্থানে সন্ধান করেও তার খোঁজ পাননি। কুদ্দুশের পরিবারও গত বৃহস্পতিবার গুম তদন্ত কমিশনে পৃথক একটি অভিযোগ দিয়েছেন।
অন্যদিকে ২০১৭ সালের ১৯ এপ্রিল একই কায়দায় তালতলী মোড় থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল বাগমারার গোয়ালকান্দি ইউনিয়নের পলাশি গ্রামের মৃত সাইদুর রহমানের ছেলে মুরশিদুল আলমকে (৩২)। মুরশিদের পরিবারও গুম কমিশনে অভিযোগ জমা দিয়েছেন।
জানা গেছে, গত কয়েক বছরে বাগমারা এলাকা থেকে আরও সাতজনকে বিভিন্ন সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নেওয়া হলেও তারা বিভিন্ন সময়ের ব্যবধানে পরিবারের কাছে ফিরে আসেন।