জুতা ব্যবসায়ী থেকে কোটি কোটি টাকার মালিক যুবলীগ নেতা সহিদ
জলিল রহমান, পটুয়াখালী
প্রকাশ: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৪:০০ পিএম
প্রতিমন্ত্রীর ছেলে আর মেয়রের বন্ধু পরিচয়ের প্রভাব খাটিয়ে পটুয়াখালীর সরকারি দপ্তরগুলোর টেন্ডারের কাজ বাগিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন যুবলীগ সভাপতি শহিদুল ইসলাম সহিদ। নামে-বেনামে গড়ে তুলেছেন সম্পদের পাহাড়। ঢাকার অভিজাত এলাকায় তার রয়েছে একাধিক ফ্ল্যাট ও প্লট। কুয়াকাটা ও পায়রা বন্দরেও তার রয়েছে একরে একরে জমি। ২ কোটি টাকার বিনিময়ে পদ বাগিয়ে বনে গেছেন পটুয়াখালী জেলা যুবলীগের সভাপতিও। মহাক্ষমতাধর আলোচিত এই যুবলীগ নেতা ৫ আগস্টের ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর লাপাত্তা হওয়ায় তার কথা এখন পটুয়াখালীর মানুষের মুখে মুখে।
২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার আগে পটুয়াখালীর নিউমার্কেটে জুতার ব্যবসা করতেন সহিদ। তখন তিনি কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত না থাকলেও জেলা আওয়ামী লীগের প্রয়াত সাবেক সভাপতি ও সাবেক ধর্মপ্রতিমন্ত্রী মো. শাহজাহান মিয়ার এলাকায় বাসা হওয়ায় তিনি মন্ত্রী পরিবারের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলেন। তার ছোট ছেলে আরিফুজ্জান রনির সঙ্গে গড়ে ওঠে তার গভীর বন্ধুত্ব। দুই বন্ধু মিলে পৌর নিউমার্কেটে আফজাল সু’র হোলসেলার হিসাবে শুরু করেন জুতার ব্যবসা। কোনো মতে তাদের ব্যবসা টিকে থাকলেও ২০০১ সালের পরে রনি বিএনপির মামলায় জড়িয়ে ইতালিতে পাড়ি জমালে তিনি বেকায়দায় পড়েন। নানা টানাপোড়নে এক সময়ে সহিদের জুতার ব্যবসা লাটে ওঠে।
২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে পটুয়াখালী-১ আসন থেকে আওয়ামী লীগের এমপি অ্যাভোকেট মো. শাহজাহান মিয়া শেখ হাসিনার মন্ত্রিসভায় ধর্মপ্রতিমন্ত্রী হিসাবে ঠাঁই পান। রনি ইতালি থেকে দেশে আসার পর মন্ত্রীপুত্রকে পুঁজি করে টাকা কামানোর মিশনে নামেন সহিদ। এরই মধ্যে জেলা যুবলীগ সভাপতি আহসান হাবিব খানের আকস্মিক মৃত্যুতে তার খোলা পালে বাতাস লাগে। মন্ত্রীর ক্ষমতা আর তৎকালীন কেন্দ্রীয় যুবলীগের চেয়ারম্যান হারুন অর রশীদ চৌধুরীকে কোটি টাকা দিয়ে রনি আহ্বায়ক ও শহিদুল ইসলাম নিজে যুগ্ম-আহ্বায়ক হয়ে পটুয়াখালী জেলা যুবলীগকে কব্জা করেন। পৌরসভা ভোট কেন্দ্রে তৎকালীন ধর্মপ্রতিমন্ত্রী শাহজাহান মিয়ার সামনেই ভোট কেন্দ্রে পুলিশকে মারধর করে আলোচনায় আসেন সহিদ। এরপর আর তাকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। মন্ত্রী পরিবারের আশীর্বাদে স্বাস্থ্য বিভাগ, পটুয়াখালী এলজিইডি, পানি উন্নয়ন বোর্ড, রোডস, বিআরডিসি জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর ও গণপূর্তসহ সব সরকারি দপ্তরের উন্নয়নের ঠিকাদারি কাজ গোছাতে শুরু করেন। জেলার যে কোনো উন্নয়ন কাজ নিতে হলে ঠিকাদারকে সহিদের নেতৃত্বে গড়ে উঠা টেন্ডার কমিটিকে ১০ থেকে ২০ ভাগ পর্যন্ত নগদ বখড়া দিতে হতো। কমিশনের এই টাকা লেনদেনের প্রক্রিয়া সম্পন্নের পর টেন্ডার কমিটির মূলহোতা সহিদের সবুজ সংকেতের পর মিলত ঠিকাদারদের কার্যাদেশ।
পটুয়াখালী এলজিইডির এক উপসহকারী প্রকৌশলী যুগান্তরকে জানান, ২০০৮’র পর এলজিইডি টেন্ডারের কাজ চলত যুবলীগ নেতা সহিদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা টেন্ডার কমিটির কথায়। প্রত্যেকবার টেন্ডারে ৩০ থেকে ৫০ লাখ টাকার ওপরে বিটমানি উঠত। এক পর্যায়ে এ নিয়ে পটুয়াখালী এলজিইডিএর নির্বাহী প্রকৌশলী আবু বাসেত বেকে বসলে তার ওপর রনি-সহিদের নেতৃত্বে হামলা চালায় টেন্ডার কমিটির সদস্যরা। পরে প্রতিমন্ত্রী শাহজাহান মিয়ার মধ্যস্থতায় এ ঘটনা ধামাচাপা দেওয়া হয়। এভাবে প্রতি বছর শুধু টেন্ডার কমিটির নামেই কোটি টাকা হাতিয়ে নেন যুবলীগ নেতা সহিদ। পটুয়াখালী সদর হাসপাতাল ও উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোতে নামমাত্র খাদ্য ও পথ্য সরবরাহের নামে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেন তিনি।
মন্ত্রী পরিবারের সঙ্গে সখ্যের জোরে তিনি চাকরি বাণিজ্যও করেন। ধর্ম মন্ত্রণালয়ের অধীনে বাইতুল মোকাররম মসজিদের স্টল বাণিজ্য ও হজের লাইসেন্সের দালালি করেও তিনি কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। এভাবে আওয়ামী লীগের ক্ষমতার ১৫-১৬ বছরে টেন্ডার বাণিজ্য, চাকরি বাণিজ্য, কমিশন বাণিজ্য ও বিভিন্ন দালালি করে সহিদ হাতিয়ে নিয়েছেন প্রায় শত কোটি টাকা। এক সময়ে জুতার দোকানদার সহিদের কিছু না থাকলেও এখন তার সবই আছে। ঢাকার বাড্ডায় একই ভবনে ২টি ফ্ল্যাট, উত্তরা ও মোহাম্মদপুরে ২টি ফ্ল্যাট, ঢাকার নিউমার্কেটে দোতলায় ২টি ও নিচতলায় একটি দোকান রয়েছে। স্ত্রী ও কর্মচারী আল-আমিনের নামেও নিউমার্কেটে দোকান রয়েছে বলে জানায় সহিদের কয়েকজন ঘনিষ্ট বন্ধু। তার ঘনিষ্টদের অনেকেই নাম প্রকাশ না করার শর্তে যুগান্তরকে এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তার নিজের ও স্ত্রীর নামে বসুন্ধরা ও পূর্বাচলে ২টি প্লট রয়েছে। পটুয়াখালী শহরের চরপাড়ায় মুসা কুটিরেও সহিদের একটি ফ্ল্যাট আছে। স্ত্রীর বড় ভাই মাসুম তালুকদারের কাঠের ব্যবসা ও ফার্নিচার তৈরির কারখানায় লগ্নি করেছেন মোটা অঙ্কের টাকা। জেলার কলাপাড়া পায়রা সমুদ্র বন্দর এলাকায় সাড়ে ৩ একর, পর্যটন কেন্দ্র কুয়াকাটায় নামে-বেনামে তার জমি রয়েছে বলে যুবলীগের কয়েকজন নেতা জানিয়েছে। লন্ডন প্রবাসী ছোট ভায়রার সঙ্গে তার ব্যবসা বাণিজ্য রয়েছে বলেও জানা গেছে। এই ভায়রার কাছেও তিনি বড় অঙ্কের টাকা হুন্ডির মাধ্যমে পাচার করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
প্রতিমন্ত্রীপুত্র রনির কাঁধে ভর দিয়ে বিভিন্ন উপায়ে প্রায় শত কোটি টাকার মালিক বনে যাওয়া সহিদ বন্ধুকে শেষ পর্যন্ত বুড়ো আঙুল দেখিয়েছেন। ৯ বছর আহ্বায়ক কমিটির দায়িত্ব পালন শেষে ২০২১ সালের ২০ ডিসেম্বর সম্মেলন শেষে বন্ধুর পদও গিলে খেয়েছেন সহিদ। কেন্দ্রে রনির জন্য সভাপতি পদের তদবির করতে গিয়ে যুবলীগ চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস পরশকে ১ কোটি ও তার স্ত্রী নাহিদ সুলতানা জুথিকে ৮০ লাখ টাকা দিয়ে নিজেই পটুয়াখালী জেলা যুবলীগের সভাপতির পদ বাগিয়ে নিয়েছেন। জেলা যুবলীগের এই কমিটি ঘোষণার পর তখন পটুয়াখালীতে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় বইয়ে যায়। ৫ আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর শত কোটি টাকার মালিক সহিদই শুধু না পটুয়াখালী থেকে লাপাত্তা হয়ে গেছে তার চ্যালাচামটা সবাই। পটুয়াখালী জেলা যুবলীগ সভাপতির গা ঢাকা দেওয়ার পরই সহিদকে নিয়ে আলোচনা ও সমালোচনার ডাল-পালা মেলতে শুরু করে। অনেকেই আবার এত সম্পদ অর্জনের উৎস খুঁজে দেখারও দাবি জানিয়েছেন। এসব বিষয়ে কথা বলতে সহিদের সঙ্গে গত কয়েক দিন ধরে বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও মোবাইল বন্ধ থাকায় তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। তার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের ব্যাপারে খোঁজ নিতে দুর্নীতি দমন কমিশন ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছে বলে জানা গেছে।