১ কোটি টাকার বিল থেকে ৪১ লাখ টাকা আত্মসাতের চেষ্টা
কুবি প্রতিনিধি
প্রকাশ: ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৯:৫৩ পিএম
এস এম শহীদুল ইসলাম
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে (কুবি) স্পোর্টস গ্যালারি নির্মাণ ও উপাচার্যের বাংলো মেরামতে খরচ হয় ৫৯ লাখ ৬৮ হাজার টাকা; কিন্তু সেই বিল ৪১ লাখ টাকা বাড়িয়ে ১ কোটি ৭৯ হাজার টাকা দেখিয়েছেন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।
গত ৫ আগস্ট ছাত্রজনতার আন্দোলনের মুখে ক্ষমতা ছেড়ে শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পরে দেশের বিভিন্ন সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতির চিত্র সামনে আসছে।
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে উঠে এসেছে অর্থ লোপাটের এমন ভয়াবহ চিত্র।
অভিযোগে জানা গেছে, ঠিকাদারের সঙ্গে যোগসাজশ করে টাকা নিত প্রকৌশলী এস এম শহীদুল ইসলাম। সেই টাকা থেকে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা উপাচার্যের কাছে চলে যেত।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. এএফএম আবদুল মঈনের মদদে মাত্র দুটি কাজ থেকেই প্রায় ৪১% টাকা আত্মসাতের চেষ্টা করেন কুবির প্রধান প্রকৌশলী শহীদুল ইসলাম।
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের দাবি, প্রকৌশলী শহীদুলের চাপে পড়ে বাধ্য হয়ে ৫৯ লাখ টাকার বিল ১ কোটি টাকা উল্লেখ করে জমা দিতে হয়েছে।
এ অভিযোগের বিষয়ে প্রকৌশলী শহীদুল জানান, উপাচার্য মঈন যেভাবে বিল করতে বলেছেন তিনি সেভাবে বিল প্রস্তুত করেছেন। এখানে তার করার কিছু ছিল না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে খেলোয়াড়দের জন্য নির্মিত স্পোর্টস গ্যালারি ও বাস্কেটবল গ্রাউন্ড কাজ পান ড্রিম ইঞ্জিনিয়ারিং নামের একটা কোম্পানি। যার টেন্ডার আইডি নং-৯৩৭১৪৯। এই কাজের কার্যাদেশ মূল্য ধরা হয়েছিল চুরাশি লাখ একানব্বই হাজর তেইশ টাকা।
অন্যদিকে উপাচার্যের বাংলো সংস্কারের কাজ পান ওরিয়েন্টাল নামে এক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। যার টেন্ডার আইডি নং-৯৫০৭১৮ এর কার্যাদেশ মূল্য ছিল তেইশ লাখ চার হাজার একশত ষাট টাকা। তবে সরকারের পতনের ফলে উপাচার্য অধ্যাপক ড. এএফএম আবদুল মঈন পদত্যাগ করলে উল্টে যায় সবকিছু।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো টাকার জন্য আবেদন করলে আবেদনের প্রেক্ষিতে সরেজমিন পরিদর্শন শেষে বিল আসে উনচল্লিশ লাখ আটাত্তর হাজার সাত শত উনত্রিশ টাকা ও আট লাখ সাতচল্লিশ হাজার পাঁচশত বাহাত্তর টাকা। কিন্তু কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশলী সবুজ বড়ুয়া ও মোহাম্মদ মফিজুল ইসলামের সাক্ষরিত একটি বিলের কপিতে দেখা যায় এই বিল যথাক্রমে তিরাশি লাখ চৌষট্টি হাজার সাতশত বাহাত্তর টাকা ও তেইশ লাখ চার হাজার একশত ষাট টাকা।
প্রকৌশল দপ্তরের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এই বিল দপ্তরের কেউ করে নাই। প্রধান প্রকৌশলী এস এম শহীদুল ইসলাম নিজে টাইপ করে জোর করে অন্য প্রকৌশলীদের দিয়ে স্বাক্ষর করান। ওই সময় তিনি বলেন, উপাচার্য স্যার সবকিছুর জিম্মাদার আপনাদের এত চিন্তা কিসের? আপনারা স্বাক্ষর করেন, ওনি বিল আটকে রাখবে, কাজ শেষ হলে বিল দিবেন তিনি।
অর্থ দপ্তরের সূত্রে জানা গেছে, প্রকৌশল দপ্তর বিলের টাকা নিতে দুইবার বিলের কপি জমা দেন; কিন্তু বিলের মধ্যে গরমিল থাকার কারণে অর্থ দপ্তর বিলের কপি রিসিভ করতে অপারগতা প্রকাশ করেন। অর্থ দপ্তর সরেজমিনের বিল এবং কাজের তদারকি বিষয়ে জানতে প্রকৌশল দপ্তরে চিঠি দিলে তারা উল্লিখিত বিল উপস্থাপন করেন; কিন্তু ৫ আগস্ট আওয়ামী সরকার পতন হলে তড়িঘড়ি করে করে ৯ ফেব্রুয়ারি সরেজমিন পরিদর্শনের কথা (ব্যাকডেইট দিয়ে) গত ৭ আগস্ট আরেকটি বিল উত্থাপন করেন প্রকৌশলী অধিদপ্তর। এই বিল উত্থাপন করার আগেও দুইবার পরিবর্তন হয় এই বিল।
গত ১৪ জুলাই টাকা চেয়ে চিঠি দেয় প্রকৌশল দপ্তর। ইস্যু করা চিঠিতে বিল উপস্থাপন করেন আটান্ন লাখ পাঁচ হাজার টাকা ও পনেরো লাখ উনসত্তর হাজার টাকা। সেই চিঠি নিয়ে টাকা দিতে অপারগতা প্রকাশ করলে ৭ আগস্ট পুনরায় বিলের কপি দেয় প্রকৌশল দপ্তর। সেখানে বিলের পরিমাণ উল্লেখ করা হয় ঊনচল্লিশ লাখ আটাত্তর হাজার সাতশত উনত্রিশ টাকা ও আট লাখ সাতচল্লিশ হাজার পাঁচশত বাহাত্তর টাকা। তবে সব বিলের কপিতে ৩০ জুনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
ড্রিমের ঠিকাদার মোস্তাক বলেন, আমরা কাজ শেষ করেছি কিন্তু তারা টাকা দিচ্ছে না। বিলের জন্য চিঠি দিলেও নানান কারনে বিল আটকে দিচ্ছে। প্রকৌশলী আব্দুল লতিফ ও মুফিজুল ইসলাম আমার ইঞ্জিনিয়ার ফয়সালের টাকা দাবি করছে। তবে টাকার বিষয়ে ড্রিমের ম্যানেজার ফয়সাল বলেন, আমার কাছে কেউ কোনো টাকা চাইনি, মোস্তাক ভাইয়ের কাছে চাইছে কিনা জানি না।
পরে ঠিকাদার মোস্তফার কাছে টাকা চাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাকে আমার ইঞ্জিনিয়ার বলেছিল।
টাকা দাবির বিষয়ে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় প্রকৌশল দপ্তরের তত্ত্বাবধায়ক আব্দুল লতিফ বলেন, মোস্তাক আমার কাছে এসে বলে ভিসি স্যার, পিডি স্যার (শহীদুল ইসলাম) মেনে নিয়েছে। আপনার বিলে সই করতে সমস্যা কোথায়? কত টাকা লাগবে আপনার? তখন আমি বলি চল্লিশ লাখ টাকার কাজে চুরাশি লাখ টাকার বিল করা কাগজে আমি সই করি না। যদি তারা টাকা দিয়ে দেয় তাহলে আমার কোনো সমস্যা নেই।
তিনি বলেন, আমি তাদের কাছে কোনো ধরনের টাকা চাইনি। বরং আমি সরেজমিন যত টাকার কাজ হয়েছে তত টাকার রিপোর্ট করেছি। সেজন্য তারা আমার নামে অপ্রচার করছে।
প্রকৌশলী শহীদুল ইসলাম বলেন, আমি সব কাজ অন্য প্রকৌশলীদের ভাগ করে দিয়েছি। আমার চেয়ে তারা ভালো বলতে পারবেন।
সরকার পতনের পর কেন এত বড় বিল এত কম হয়ে গেল? জানতে চাইলে তিনি আমতা আমতা করে বলেন, ওটা বিল ছিল না ড্রাফট ছিল।
বিল তিনবার কেন পরিবর্তন হলো? জানতে চাইলে তিনি বলেন সেটা আমার জানা নাই। বিলে ব্যাকডেইট দিয়ে কেন স্বাক্ষর করলেন সেটা জানতে চাইলে প্রথমে বলেন-জুন ক্লোজিং এর বিষয়। সেজন্য আমরা হিসাবটা করে ফেলছি। পরে অস্বীকার করে বলেন, এটা জুনের কাজ জুনেই শেষ করা হয়েছে, কোন ব্যাকডেইট না।
প্রকল্প থেকে টাকা আত্মসাতের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, টাকা আত্মসাতের প্রশ্নই আসে না। ভিসি স্যার আমাকে যে রকম নির্দেশনা দিয়েছেন সেই রকম করেছি।