গুলিবিদ্ধ রিকশাচালক জামাল নিহত হওয়ার ২২ দিনেও পরিবারের খোঁজ নেয়নি কেউ
হাটহাজারী (চট্রগ্রাম) প্রতিনিধি
প্রকাশ: ২৬ আগস্ট ২০২৪, ১০:৫৭ পিএম
দিনটি ছিল গত ৫ আগস্ট। ঘড়ির কাঁটা তখন ৬ এর ঘর ছুঁই ছুঁই। পশ্চিম দিগন্ত বেয়ে সন্ধ্যার রঙিন আভা নেমে আসছে। এমন মুহূর্তে চট্টগ্রামের হাটহাজারী মডেল থানার সামনে গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন ব্যাটারিচালিত রিকশাচালক মো. জামাল মোল্লা (৫২)।
সেদিন বিকালে তিনি পরিবারের সদস্যদের নিয়ে তার বড় মেয়ের জন্য ছেলে দেখতে গিয়েছিল হাটাজারী পৌরসভার আব্বাছিয়ার পুল এলাকায়। এ সময় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা চট্টগ্রাম খাগড়াছড়ি মহাসড়ক অবরোধ করে রাখায় মেয়ের জন্য পাত্র দেখে পরিবারের অন্য সদস্যরা মহাসড়কের পশ্চিমে রেললাইন হয়ে বাড়ি ফিরলেও পুলিশের গুলিতে রিকশাচালক জামাল লাশ হয়ে বাড়ি ফিরে।
নিহত রিকশাচালক জামাল চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের বায়েজিদ থানাধীন কুলগাঁও ট্যানারি বটতলির মাজার গেট এলাকার ছালে আহাম্মেদ প্রকাশ ফেঞ্জুর বাড়ির ছালে আহাম্মেদের পুত্র। তিনি গত তিন বছর ধরে হাটহাজারী পৌরসভার পশ্চিম দেওয়ান নগর আর্মি ফায়ার সেন্টার সংলগ্ন সন্দ্বীপ পাড়া হাজীরতলীতে সরকারি পাহাড়ী টিলায় বসবাস করে আসছিল। তিনি এক ছেলে মোহাম্মদ আল-আমিন (১৫) ও মেয়ে তানিয়া আক্তার (১৭) সন্তানের জনক ছিলেন।
এদিকে পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তির এমন মৃত্যুতে অন্ধকার দেখছেন পুরো পরিবার। স্বামীকে হারিয়ে দুই সন্তানকে নিয়ে অকূল পাথারে পড়েছেন রিকশাচালক জামালের স্ত্রী তাসলিমা বেগম। ভুগছেন আর্থিক সংকটে। পাশাপাশি এনজিও থেকে পরিবারের স্বচ্ছলতা ফেরানো পাশাপাশি পাহাড়ি টিলায় ঘর তৈরি করতে প্রায় দেড় লাখ টাকার মতো নেওয়া রিকশাচালক জামালের ঋণের কিস্তি শোধ করতে তাসলিমা বেগমকে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
সোমবার বিকালে স্বামীহারা তাসলিমা বেগম অশ্রুসিক্ত নয়নে যুগান্তরকে জানান, তার স্বামী জামাল মোল্লা ছিলেন পরিবারের একমাত্র ভরসা। বিগত ২০০২ সালে তিনি মো. জামাল মোল্লা সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তাদের দাম্পত্য জীবনে দুটি সন্তান নিয়ে রিকশা চালিয়ে তার স্বামী কোনরকমে দিনাতিপাত করে আসছিল। তবে হঠাৎ চোখের পলকে পুলিশের গুলিতে নিহত হয়ে আমার স্বামী পরপারে চলে গেল। আমি নিঃস্ব হয়ে গেলাম।
তিনি আরও বলেন, আমার স্বামীর কী দোষ ছিল? তিনি তো কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। তাকে হত্যা করা হলো কেন? আমার সন্তানকে আমি কোন জবাব দিতে পারছি না। কে সান্ত্বনা দেবে আমার সন্তানদের? স্বামীর উপার্জনে পরিবার চলত। আমার স্বামীর হত্যাকারীদের বিচার চাই। আমার স্বামী নিহত হওয়ার ২২ দিন অতিবাহিত হওয়ার পরও কেউ আমার পরিবার ও আমার সন্তানদের খবর নিল না। দুই ছেলেমেয়েকে নিয়ে আমাকে দুর্বিষহ জীবনযাপন করতে হচ্ছে।
প্রসঙ্গত, গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পদত্যাগ ও সেনাপ্রধানের বক্তব্য দেওয়ার পর ছাত্র-জনতা, বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের হাজার হাজার নেতাকর্মীরা আনন্দ মিছিল ও উল্লাস করতে শুরু করেছিল। সেদিন সন্ধ্যা ৬টার দিকে আনন্দ মিছিল ও উল্লাসের এক পর্যায়ে একদল বিক্ষুব্ধরা হাটহাজারী মডেল থানার মূল ফটক ভেঙ্গে কম্পাউন্ডে প্রবেশ করে প্রথমে ইট পাটকেল ছুড়ে গ্লাস ভাঙচুর করে।
এরপর তারা কম্পাউন্ডে এর ভিতরে রাখা পুলিশের একটি সাজোয়ারজান (এপিসি), একটি পিকআপ ও একটি মোটরসাইকেল ভাংচুর করে। এ সময় পুলিশ হ্যান্ডমাইকে বারবার বিক্ষুব্ধদের সরে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করে।
তারপরও বিক্ষুব্ধরা ক্ষুব্ধ হয়ে থানায় হামলা চালালে পুলিশ তাদের ভবনের ওপর থেকে আত্মরক্ষার্থে গুলি ছোড়ে। ওই সময় বিক্ষুব্ধরা পিছু হাঁটলে পুলিশ থানার সামনে চট্টগ্রাম-খাগড়াছড়ি মহাসড়কে এসে বিক্ষুব্ধদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়লে পুলিশের গুলিতে রিকশাচালক জামালসহ ৬ জন গুলিবিদ্ধ হন।
এ সময় স্থানীয়রা তাকে প্রথমে উপজেলা স্বাস্থ্যকমপ্লেক্স, পরে চমেক হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়।
অন্যদিকে রিকশাচালক নিহত জামাল মোল্লার ছেলে আল আমিন বলেন, বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে আর্থিক সংকটে পড়েছে আমাদের পরিবারটি। আমি পৌরসভা এলাকায় একটি ফিলিং স্টেশনে স্বল্প বেতনে চাকরি করি। আমাকে বাবার দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। তবে আমি ও আমার পরিবারের ভবিষ্যৎ কী হবে?
এ ব্যাপারে হাটহাজারী মডেল থানার পুলিশ পরিদর্শক (গোয়েন্দা) মো. ছৈয়দ ওমরের কাছে জানতে চাইলে তিনি নিহত রিকশাচালক জামাল মোল্লার মৃত্যুর প্রসঙ্গে কিছু জানেন না বলে জানান।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবিএম মশিউজ্জামান উক্ত ঘটনার ব্যাপারে কোনো কিছু জানাতে পারেননি।