রাজশাহীতে আত্মগোপনে জনপ্রতিনিধিরা, ভোগান্তিতে সেবাপ্রার্থীরা

রাজশাহী ব্যুরো
প্রকাশ: ১২ আগস্ট ২০২৪, ০৮:০৭ পিএম

ফাইল ছবি
গত দুই সপ্তাহ ধরে বন্ধ রাজশাহীর ৭২ ইউনিয়ন, ১৪ পৌরসভা ও ৯ উপজেলা পরিষদের সেবা কার্যক্রম। রাজশাহীর স্থানীয় সরকার বিভাগের এসব প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ থাকায় ভোগান্তিতে পড়েছেন সেবাপ্রার্থী হাজারও মানুষ।
গত ৫ আগস্ট থেকে রাজশাহীতে চলা সহিংসতা ও ধ্বংসযজ্ঞের শিকার হয়েছে স্থানীয় সরকার বিভাগের অনেক প্রতিষ্ঠান। পলাতক রয়েছেন উপজেলা পরিষদের অনেক চেয়ারম্যান, পৌরসভার মেয়র ও অধিকাংশ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানরা।
জানা যায়, রাজশাহীর ১৪ পৌরসভার প্রায় সব মেয়রই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। অনেকের দলীয় পদ-পদবিও রয়েছে। দুই-একজন জনপ্রতিনিধি বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকলেও পরিস্থিতির ভয়াবহতার কারণে তারাও দপ্তরে যাচ্ছেন না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজশাহীর ১৪ পৌরসভার মধ্যে গোদাগাড়ীর অয়েজুদ্দিন বিশ্বাস উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। চিকিৎসা শেষে ১ আগস্ট ভারত থেকে ফিরলেও তিনি আর অফিসে যেতে পারেননি।
গত ৫ আগস্ট সহিংসতা শুরু হলে অয়েজুদ্দিন বিশ্বাস এখন আত্মগোপনে রয়েছেন। তানোর পৌরসভার মেয়র ইমরুল হক পলাতক। এছাড়া আড়ানী পৌরসভার মেয়র মুক্তার হোসেন ছাত্র আন্দোলন শুরুর পরপরই এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যান। যদিও মুক্তারের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে হওয়া অস্ত্র, মাদক ও অর্থপাচারের অভিযোগে তিনটি মামলা বিচারাধীন।
এদিকে তাহেরপুর পৌরসভার নবনির্বাচিত মেয়র শায়লা খন্দকারের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। তার স্বামী রাজশাহী-৪ (বাগমারা) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আবুল কালাম আজাদের দুটি গাড়ি ও বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। স্বামী-স্ত্রী উভয়ই এখন আত্মগোপনে।
এলাকাবাসী জানান, গত ৩১ জুলাই থেকেই তাহেরপুর পৌরসভা তালাবদ্ধ। ভবানীগঞ্জ পৌরসভাও তালাবদ্ধ রয়েছে। মেয়র পলাতক থাকায় কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও কার্যালয়ে আসেন না।
এছাড়া বাঘা পৌরসভার মেয়র আক্কাছ আলী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আশরাফুল ইসলাম বাবুল হত্যার প্রধান আসামি হিসেবে আগে থেকেই পলাতক আছেন। বলতে গেলে গত জুন মাস থেকেই বাঘা পৌরসভার সেবা কার্যক্রম বন্ধ। এতে সেবাপ্রার্থী পৌরবাসীর ভোগান্তি বেড়েছে।
পৌরসভার বাসিন্দা নজরুল মালিথা বলেন, আমরা কোনো সেবা পাচ্ছি না। মেয়র পলাতক আবার কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও পলাতক। জেলার পুঠিয়া পৌরসভার মেয়র আল মামুন খান উপজেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক। পরিস্থিতির কারণে তিনিও অফিসে বসতে পারছেন না। কারণ বিএনপির আরেকটি গ্রুপের সঙ্গে তার বিরোধ রয়েছে। তবে পুঠিয়া পৌরসভার কার্যক্রম সীমিত আকারে চলছে বলে জানিয়েছেন এলাকাবাসী।
অন্যদিকে বিপুল ভোটে নির্বাচিত গোদাগাড়ী উপজেলা চেয়ারম্যান যুবলীগ নেতা বেলাল উদ্দিন সোহেলও তার অফিসে যাচ্ছেন না। তানোর উপজেলা চেয়ারম্যান লুৎফর রশীদ হায়দার ময়নাও পলাতক। বাঘা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক লায়েব উদ্দিন লাভলু সর্বশেষ গত ৮ আগস্ট অফিসে গেলেও কিছুক্ষণ পরই বের হয়ে যান।
লাভলু জানান, বাঘা এলাকায় সহিংসতায় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন সংখ্যালঘুরা। পরিস্থিতির কারণে তিনি এখনো ঠিকমতো অফিস করতে পারছেন না। তবে তিনি এলাকাতেই থাকছেন।
এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাগমারা উপজেলা চেয়ারম্যান জাকিরুল ইসলাম সান্টু জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক। গত ৫ আগস্ট থেকে তিনিও এলাকা ছাড়া। পবা উপজেলা চেয়ারম্যান ফারুক হোসেন ডাবলু ও মোহনপুর উপজেলা চেয়ারম্যান আফজাল হোসেন বকুল পলাতক বলে এলাকাবাসী জানিয়েছেন। এর মধ্যে মোহনপুর উপজেলা চেয়ারম্যানের দপ্তর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। এই তিন উপজেলা চেয়ারম্যান জেলা আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পদধারী। তাদের বাড়িঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও হামলার শিকার হয়েছে।
এদিকে রাজশাহীর ৭২ ইউনিয়ন পরিষদের অধিকাংশ চেয়ারম্যান অফিস করছেন না হামলা ও সহিংসতার আশঙ্কায়।
গোদাগাড়ীর এক ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ইউনিয়ন পরিষদের সেবা কার্যক্রম শুরুর জন্য উপজেলা নির্বাহী অফিস থেকে তাদের মৌখিক নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। মৌখিক নির্দেশে বলা হয়েছে- স্থানীয় বিএনপি ও জামায়াতের নেতাকর্মীদের সঙ্গে চা-চক্র করে যেন পরিষদের সেবা কার্যক্রম পুনরায় শুরু করা হয়। তিনি বিএনপি ও জামায়াতের নেতাদের চা চক্রে ডেকেছিলেন কিন্তু বিএনপির নেতাকর্মীরা হাজির হননি।
জানা গেছে, গোদাগাড়ীর ৯ ইউনিয়নের কোথাও সেবা কার্যক্রম শুরু হয়নি। রাজশাহীর অন্যান্য উপজেলার ইউনিয়ন পরিষদ সোমবারও তালাবদ্ধ দেখতে পেয়েছেন ওই এলাকার বাসিন্দারা।
রাজশাহীর মাটিকাটা ইউনিয়নের উজানপাড়া গ্রামের শহিদুল আলম বলেন, জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন, প্রত্যয়নসহ বিভিন্ন সেবা গ্রহীতারা বেশি বিপাকে পড়েছেন। সামাজিক নিরাপত্তার যেসব সহায়তা আছে সেগুলোও বন্ধ আছে। এতে দুস্থ গরিব মানুষেরা ভোগান্তিতে পড়ছেন। স্থানীয় পর্যায়ের উন্নয়ন কার্যক্রমও থমকে আছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাজশাহী জেলা প্রশাসনের স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-পরিচালক (উপসচিব) মো. আশরাফুল ইসলাম বলেন, আমরা ইতোমধ্যে রাজশাহীর সব পৌরসভার মেয়র, উপজেলা চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানদের দ্রুত সময়ে দাপ্তরিক কার্যক্রম শুরু করার নির্দেশ দিয়েছি। ইতোমধ্যে সরকারি সার্ভার সচল হয়েছে। সেবাপ্রার্থীরা যাতে ভোগান্তিতে না পড়েন সেজন্য সব জনপ্রতিনিধিকে নিজ নিজ অফিসে উপস্থিত হতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।