Logo
Logo
×

সারাদেশ

তিন কন্যাকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা নেই

Icon

কেন্দুয়া (নেত্রকোনা) প্রতিনিধি

প্রকাশ: ০৪ আগস্ট ২০২৪, ০২:১৯ পিএম

তিন কন্যাকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা নেই

ঋণের টাকা পরিশোধ করতে ছোট ছোট তিন শিশুকন্যাকে গ্রামের বাড়িতে বৃদ্ধ মায়ের কাছে রেখে বছরখানেক আগে ঢাকায় গিয়েছিলেন আলী হোসেন (৪৫)। সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন স্ত্রী খায়রুন্নেছাকেও (৩৫)। ঢাকার উত্তরা মুন্সি মার্কেটের একটি ভাড়া বাসায় থেকে রাস্তার পাশে বসে পান-সিগারেট বিক্রি করতেন আলী হোসেন। আর স্ত্রী খায়রুন্নেছা কাজ করতেন মানুষের বাসাবাড়িতে। এভাবেই কষ্ট করে টাকা উপার্জন করে প্রতি মাসেই গ্রামে টাকা পাঠিয়ে ঋণ পরিশোধ করতেন এবং পরিবারের সদস্যদের ভরণপোষণ চালিয়ে যেতেন তারা। 

কিন্তু গত ১৮ জুলাই বৃহস্পতিবার দুপুরে উত্তরা এলাকায় কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে পুলিশের গুলিতে নিহত হন পান বিক্রেতা আলী হোসেন। তার মৃত্যুতে নির্বাক তিন কন্যাশিশুসহ পরিবারের লোকজন। হতবাক এলাকাবাসীও। নিহত আলী হোসেনের তিন কন্যাসন্তান সাদিয়া আক্তার (১৪), মাহিবা আক্তার (৬) ও মারিয়া আক্তারকে (৩) সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা যেন নেই কারোরই। বাবাকে হারিয়ে কন্যাসন্তানের আহাজারি থামছে না। কে দেখবে তাদের। 

নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলার মোজাফরপুর ইউনিয়নের মোজাফরপুর (পশ্চিমপাড়া) গ্রামের মৃত আসন আলীর ছেলে আলী হোসেন। পরিবারের বড় সন্তান হওয়ায় বাবার মৃত্যুর পর পরিবারের ভরণপোষণের ভার পড়ে আলী হোসেনের কাধে।

পরিবারের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আলী হোসেনের পরিবারে বৃদ্ধ মা বেদেনা আক্তার, ছোট ভাই আবু বক্কর, স্ত্রী খায়রুন্নেছা ও তিন কন্যাশিশু রয়েছে। আলী হোসেন পরিবারটির সার্বিক দেখভাল করতেন। সহায় সম্পদ বলতে বসতভিটা ছাড়া আর কিছুই নেই। বৃদ্ধ মা প্রায়ই অসুস্থ থাকেন। ছোট ভাই আবু বক্করও শ্বাসকষ্টের রোগী। এ অবস্থায় গ্রামের বাজারে কাঁচামালের ব্যবসা করে কোনোরকম সংসার চালিয়ে আসছিলেন আলী হোসেন। এতে বেশ কয়েক লাখ টাকা ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন তিনি। একপর্যায়ে ঋণের টাকা পরিশোধের জন্য তিন কন্যাসন্তানকে বৃদ্ধ মায়ের কাছে রেখে বছরখানেক আগে সস্ত্রীক ঢাকায় চলে যান আলী হোসেন। সেখানে ঢাকার উত্তরা মুন্সি মার্কেটের একটি ভাড়া বাসায় থেকে উত্তরা আজমপুর রেলস্টেশন এলাকায় রাস্তার পাশে বসে পান-সিগারেটের ব্যবসা করতেন আলী হোসেন এবং স্ত্রী খায়রুন্নেছা কাজ করতেন মানুষের বাসাবাড়িতে।

খায়রুন্নেছা জানান, গত ১৮ জুলাই সকাল আটটার দিকে পানিভাত (পান্তা) খেয়ে দোকান নিয়ে বের হন স্বামী আলী হোসেন এবং তিনিও কাজে চলে যান। পরে দুপুরে বাসায় খেতে গিয়ে দেখেন স্বামী আসেনি। অথচ প্রতিদিনই তিনি দুপুরে বাসায় খেতে আসেন। একপর্যায়ে স্বামীর খুঁজে বাসা থেকে বেরিয়ে যান খায়রুন্নেছা। যেখানে স্বামী নিয়মিত দোকান নিয়ে বসতেন সেখানে গিয়ে জানতে পারেন, দোকানটি পাশের একজনের কাছে রেখে আলী হোসেন সামনে গিয়েছিলেন। কিন্তু দুই তিন ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও ফিরে আসেননি। পরে স্থানীয় কুয়েত বাংলাদেশ  মৈত্রী সরকারি  হাসপাতালে আলী হোসেনের মরদেহ পড়ে থাকার খবর পান। পরে রাত বারোটার দিকে হাসপাতাল থেকে স্বামীর লাশ নিয়ে কেন্দুয়া উপজেলার মোজাফরপুর গ্রামে বাড়িতে নিয়ে যাই। পর দিন শুক্রবার সকাল ৯টার দিকে দাফন করা হয়। 

তার স্বামী একজন সহজ সরল সাধারণ মানুষ ছিলেন জানিয়ে খায়রুন্নেছা বলেন, আমার সব শেষ হয়ে গেল। আমার ছোট ছোট তিনটি অসহায় মেয়ে সন্তান নিয়ে আমি এখন কিভাবে চলব- বুঝতে পারছি না। কে দেখবে আমাদেরকে?

কাঁদতে কাঁদতে বড় মেয়ে সাদিয়া আক্তার বলেন, বাবাই ছিল আমাদের সব। বাবাকে পুলিশ গুলি করে মেরে ফেলেছে। আমরা এর বিচার চাই। আল্লাহ যেন খুনিদের সঠিক বিচার করেন।

নিহত আলী হোসেনের বৃদ্ধ মা যেন পুত্রশোকে নির্বাক। তিনি বলেন, এভাবে ছেলের মৃত্যু হলে মায়ের যে কেমন লাগে- তা বুঝাতে পারব না। আল্লাহ আমার এমন সর্বনাশ কেন করল? আমার অবুঝ নাতনিগুলোকে এখন কে দেখবে?

স্থানীয় মোজাফরপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জাকির আলম ভূইয়া বলেন, আলী হোসেনের মৃত্যুর ঘটনাটি আমাদের ব্যথিত করেছে। তিনি ছিলেন খুব গরিব। খেটে খাওয়া একজন মানুষ। তার মৃত্যুতে পরিবারটি খুব অসহায় হয়ে পড়েছে। আমি তাদের ১০ হাজার টাকা সহায়তা প্রদান করেছি এবং আলী হোসেনের স্ত্রীকে একটি বিধবাভাতার কার্ডও করে দেয়ার ব্যবস্থা করব। তবে পরিবারটিকে ঘুরে দাঁড়াতে হলে  সরকারি সহায়তা প্রদানের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ জানাই।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম