Logo
Logo
×

সারাদেশ

নান্দাইলের শেফালি যেন এ যুগের আসমানি!

Icon

নান্দাইল (ময়মনসিংহ) প্রতিনিধি

প্রকাশ: ০৬ জুলাই ২০২৪, ১০:৩১ পিএম

নান্দাইলের শেফালি যেন এ যুগের আসমানি!

সুন্দর সুরভিত ফুলের নামে মা-বাবা তাদের মেয়ের নাম রাখেন শেফালি। পুরো নাম শেফালি রাণি বর্মণ। কিন্তু কপালে যে তার কবিতার সেই আসমানির মত দুঃখ দূর্দশা থাকবে, সেটা হয়ত তারা জানতেন না। পার্থক্য শুধু আসমানির ঘরের চালে ছিল ভেন্না পাতার ছাউনি, আর শেফালির চালে ছিন্নভিন্ন পলিথিন! ঘরের ভেতরে আসবাবপত্র যেন আর্বজনার স্তুপ।

শেফালি বর্মণের বাড়ি নান্দাইল পৌরশহরের আচারগাঁও নাথপাড়া মহল্লায়। সরকারি সব ধরনের সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত ৫৮ বছর বয়সি শেফালি নিঃসন্তান, বিধবা, সহজ সরল নিভৃতচারী এক নারী। নরসুন্ধা নদের পশ্চিম পাড়ে তার বাড়ি বলতে একমাত্র ভাঙা ঘর।

শুক্রবার বিকালে পৌর শহরের ৭নং ওয়ার্ডের আচারগাঁও নাথপাড়া মহল্লায় গিয়ে ছোট্ট ঘরের আকৃতি আর্বজনা ঘেরা একটি স্থাপনা দেখা যায়। দোচালা ঘরে ঝাঁঝরা টিনের চাল দুটি সেই কবে ভেঙে আড়ার ওপর বসে পড়েছে। চালে দিয়ে রাখা পলিথিনও এখন মন্ডে পরিণত হয়েছে। ঘরের বেড়া বলতে ভাঙা টিন, তার ওপর ছিন্ন নোংড়া কাপড়-চোপড়। আশেপাশের অন্য জমি থেকে ঘর ও সামনের উঠানটি অপেক্ষাকৃত নিচু হওয়ায় সেখানে বৃষ্টির পানি জমে কাদায় একাকার। 

প্রতিবেশিরা জানান, ২ শতক জমির ওপর অবস্থিত এ ঘরেই বসবাস করেন শেফালি। স্বামী অনিল বর্মণ নদীতে মাছ ধরে বিক্রি করে সংসার চালাতেন। সুখেই কাটছিল নিঃসন্তান ওই দম্পতির সংসার।

তবে সেই সুখ বেশিদিন স্থায়ী হয়নি শেফালির। চার বছর আগে সেই স্বামীকেও হারান তিনি। হাতে টাকা না থাকায় বাড়ি ভিটার ৪ শতক জমির ২ শতক বিক্রি করে স্বামীর শ্রাদ্ধে খরচ করেন। এরপর থেকেই একাকি শেফালির জীবন চলতে থাকে দুঃখ-কষ্টে, খেয়ে না খেয়ে। 

এত কিছুর পরেও দারিদ্রদের জন্য চালু করা সরকারের বিভিন্ন কর্মসূচির আওতায় আসেননি শেফালি। প্রতিবেশিদের সহায়তায় তার খাওয়া-পরা কোনোরকমে চললেও স্বামীর হাতে গড়া দোচালা টিনের সেই ঘরটি দীর্ঘদিনেও আর মেরামত করতে পারছেন না তিনি। ফলে শুষ্ক দিনে কোনো রকমে ঘরে বসবাস করতে পারলেও বর্ষার দিনে তাকে পড়তে হয় মহাবিপদে। কেউ তাকে অন্যত্র নিয়ে যেতে চাইলেও স্বামীর ভিটা ছাড়তে নারাজ শেফালি।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলতে বলতেই বাড়িতে ফেরেন শেফালি। এসেই দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা বাঁশের ভাঙা স্যাঁতস্যাঁতে দরজাটি খোলেন। তারপর এ প্রতিনিধিকে ঘরের ভেতরে নিয়ে সবকিছু দেখান। 

দেখা যায়, আসবাবপত্র, হাঁড়ি-পাতিল বা কাপড়-চোপড় তেমন কিছুই নেই।  ভাঙা একটি চৌকির ওপর দু-একটা নোংরা স্যাঁতস্যাঁতে কাঁথা-বালিশ। চৌকির ওপর চালের নিচেও আবার অন্য একটি নীল রংয়ের পলিথিনের কাগজ দেখে মনে হচ্ছিল যেন মশারি টানানো। চারপাশে জন্মানো আগাছা ঘরের ভেতরে উঁকি দিতে দেখা যায়। ঘরের উপর ও পাশে প্রতিবেশিদের গাছপালা থাকায় সেখানে সবসময় অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিবেশ বিরাজমান। মশায় ভরপুর হলেও শেফালির নেই কোনো মশারি। খাবারই জোটেনা, তার ওপর মশা তাড়ানোর কয়েল কিনবে কি দিয়ে, জানান স্থানীয়রা।

শেফালি জানান, তিনি সরকারি সাহায্যের আশায় বিভিন্ন জনপ্রতিনিধির কাছে বার বার গিয়েছেন, সবাই শুধু দেই দিচ্ছি করেন, কিন্তু কিছুই দেন না। এ কারণে এখন আর তাদের কাছে যান না তিনি। প্রতিবেশিরা যা দেয় তা দিয়েই চলছে তার খাওয়া-পরা। কিন্তু ঘরটি মেরামত বা নতুন করে করা তার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না।

প্রতিবেশি সুমিতা বর্মণ জানান, শেফালি দারিদ্র হলেও অন্য কারো বাড়িতে কোনো কিছু খান না। কেউ চাল ডাল দিলে তা বাড়িতে এনে রান্না করে তারপর খান। তবে নিরীহ ও শান্তশিষ্ট স্বভাবের শেফালি কখনও কারো কাছে কিছু চান না। প্রতিবেশি লাল মিয়া মন্ডল জানান, তারা সব সময় সহায়তা করলেও ঘরটি করে দিতে পারছেন না। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, শেফালি যদি ঘরের জন্য সরকারি সহায়তা না পান, তাহলে কারা পাবে?

প্রতিবেশি উত্তম বর্মণ জানান, ২ বছর আগে প্রবল বর্ষণের এক রাতে তার খোঁজ নিতে গিয়ে দেখেন ঘরে ভাঙা চৌকির ওপর বসে তিনি ভিজছেন। পরদিনই তিনি তার ঘরের চালে পলিথিন কাগজ লাগিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু সে পলিথিনও এখন নষ্ট হয়ে গেছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্থানীয় পৌর কাউন্সিলর গোলাম হায়দার খান রুপক জানান, শেফালিকে বলেছি তাকে সত্বর একটি কার্ড করে দেবেন। 
তিনি আরও জানান, ওই নারী কিছুটা লাজুক স্বভাবের। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন না। এ কারণে অনেক সময় তার কথা মনেও থাকেনা।

নান্দাইল উপজেলা সমাজ সেবা কর্মকর্তা ইনসান আলী জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থীর কাছ থেকে বিষয়টি জেনে কয়েকজনসহ শেফালির বাড়িতে গিয়ে যা দেখলাম, তা সত্যি অবিশ্বাস্য। এমন একটি ঘরে কী করে বসবাস করেন শেফালি। আগামিতে তার অফিসসহ উপজেলা পরিষদ মিলে শেফালির জন্য যা করার দরকার তাই করবেন বলেও জানান তিনি।

নান্দাইল উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা আহসানউল্লা জানান, ওই নারীকে তার বরাবরে একটি দরখাস্ত লিখতে বলেন। তিনি জেলা দুর্যোগ ত্রাণ কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে তাকে দুই বান্ডেল টিন দেবার চেষ্টা করবেন।

নান্দাইল পৌর মেয়র রফিক উদ্দিন ভূইয়া জানান, শেফালি বর্মণের বিষয়টি তার জানা ছিল না। তাকে সোমবার পৌর-কার্যালয়ে পাঠাবেন। ওইদিন তাকে প্রাথমিক অবস্থায় কিছু চাল দেবেন। এরপর অন্যান্য কার্ড দেওয়ার পাশাপাশি সাধ্যমত যা যা করার দরকার তা করবেন। 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম