নববধূর ‘ইজ্জতের মূল্য’ সোয়া লাখ থেকে কমে ৩০ হাজার টাকা!
নড়াইল প্রতিনিধি
প্রকাশ: ৩০ জুন ২০২৪, ১০:২৯ পিএম
প্রতীকী ছবি
গ্রাম্য সালিশে প্রথমে এক নববধূর (১৯) ইজ্জতের মূল্য ধরা হয় এক লাখ ২৫ হাজার টাকা! এর পর তা কমে দাঁড়ায় মাত্র ৩০ হাজার টাকায়। তারপরও অভিযুক্তের পরিবার প্রভাবশালী হওয়ায় দুই দফায় গ্রাম্য সালিশ বৈঠক হলেও জরিমানার একটি টাকাও দেওয়া হয়নি নববধূর পরিবারকে।
নড়াইলের কালিয়া উপজেলার চাঁচুড়ী গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। অভিযুক্ত বখাটে আহাদ মোল্যা (৩৫) উপজেলার চাঁচুড়ী গ্রামের বাসিন্দা মোশারফ হোসেন মোল্যার ও রানা মুসাল্লী ওরফে ফেলা (৩০) একই গ্রামের মহিদুল মুসাল্লীর ছেলে।
লিখিত অভিযোগ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ২২ জুন বেলা ১১টার দিকে উপজেলার চাঁচুড়ী বিল এলাকায় মৎস্য ঘেরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে স্বামীর সঙ্গে ঘুরতে বের হন এক নববধূ। এ সময় ওই মৎস্য ঘেরে উপজেলার চাঁচুড়ী গ্রামের চিহ্নিত বখাটে ও মাদকাসক্ত আহাদ মোল্যা (৩৫) ও একই গ্রামের রানা মুসাল্লী ওরফে ফেলা (৩০) ভুক্তভোগী নারীর স্বামীর ওপর হামলা করে। তাকে ধরে দূরে নিয়ে আটকে রেখে মারধর করেন ও হত্যার হুমকি দেয়। পরে আহাদ মোল্যা ওই নারীকেও চড়-থাপ্পড় মেরে শ্লীলতাহানি করে ও জোরপূর্বক ধর্ষণের চেষ্টা চালায়। সঙ্গে থাকা স্বর্ণালংকার, আইফোন ও নগদ কিছু টাকা ছিনিয়ে নিয়ে যায়।
এ ঘটনায় ওইদিন রাতেই ভুক্তভোগী নারীর স্বামী বাদী হয়ে ঘটনার সঙ্গে জড়িত আহাদ মোল্যা (৩৫) ও রানা মুসাল্লীকে অভিযুক্ত করে কালিয়া থানায় ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগ দায়ের করেন। তবে রহস্যজনক কারণে ঘটনার প্রায় ৯দিন অতিবাহিত হলেও এখনো অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে পুলিশ ব্যবস্থা নেয়নি বলে ভুক্তভোগীর পরিবার জানায়।
এদিকে ঘটনার দুইদিন পর ২৪ জুন রাতে চাঁচুড়ী গ্রামের উত্তর পাড়ার বাসিন্দা ফসিয়ার রহমান শেখের বাড়িতে প্রথম দফার গ্রাম্য সালিশে এক লাখ ২৫ হাজার টাকায় ঘটনাটি ধামাচাপা দেওয়া চেষ্টা করা হয়। কিন্তু এই গ্রাম্য সালিশে প্রতিপক্ষের সালিশদার চাঁচুড়ী পুরুলিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও অভিযুক্ত আহাদ মোল্যার বড় ভাই প্রভাবশালী মো. আশরাফুল ইসলাম জরিমানার টাকার পরিমাণ বেশি হওয়ায় তা প্রত্যাখ্যান করেন।
এ নিয়ে গত কয়েকদিন ধরে উভয়পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করায় শনিবার বিকালে বিষয়টি মীমাংসা করতে পুনরায় কৃষ্ণপুর-ডহর চাঁচুড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে ডাকা সালিশে সাবেক চাঁচুড়ী ইউপি চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলামের নেতৃত্বে সাবেক উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তফা, চাঁচুড়ী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি নাজির হোসেন মোল্যা, কালিয়া উপজেলা সমাজ সেবা কার্যালয়ে কর্মরত ইউনিয়ন সমাজকর্মী ও স্থানীয় মাতব্বর হারুন অর রশীদসহ স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের উপস্থিতিতে নববধূর ইজ্জতের মূল্য পুনর্নির্ধারণ করা হয় ৩০ হাজার টাকা! কিন্তু ভুক্তভোগী নারীর পরিবার সালিশের এ রায় প্রত্যাখ্যান করেন। ফলে ২য় দফায় সালিশি বৈঠক করেও বিষয়টি মীমাংসায় ব্যর্থ হন স্থানীয়রা।
সালিস বৈঠকের আহবায়ক সাবেক চাঁচুড়ী ইউপি চেয়ারম্যান সিরাজুল হক বিশ্বাস ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগে সালিশের বিষয়টি স্বীকার করে জানান, ঘটনাটি স্পর্শকাতর হওয়ায় গ্রামের ইজ্জতের কথা চিন্তা করে সামাজিকভাবে এলাকার লোকজন নিয়ে দুইবার সালিশ করেছি। প্রথমে এক লাখ ২৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হলেও অভিযুক্ত পক্ষ মানেনি। বিধায় ২য় দফায় জরিমানা ৩০ হাজার টাকা পুনর্নির্ধারণ করা হয়েছে! এলাকার গণ্যমান্য লোকজন উপস্থিত থেকে বিচার করেছেন বলে জানান তিনি।
এ প্রসঙ্গে কালিয়া থানার ওসি খন্দকার শামীম উদ্দিন বলেন, চাঁচুড়ী বিল এলাকায় মৎস্য ঘেরে মারধর করে শ্লীলতাহানির ঘটনার বর্ণনা দিয়ে এক ভুক্তভোগী গৃহবধূর স্বামী দুইজনকে আসামি করে থানায় লিখিত অভিযোগ দিলেও তারা আর কোনো যোগাযোগ করেনি। গ্রাম্য সালিশে বিষয়টি মীমাংসা হয়েছে কিনা এটা তাদের বিষয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় এক জনপ্রতিনিধি বলেন, ওই দিন খবর পেয়ে বিষয়টি থানার ওসিকে জানান তিনি। পরে ভুক্তভোগী গৃহবধূর স্বামী থানায় লিখিত অভিযোগ দেয়। ঘটনার দুদিন পর উভয়পক্ষ ঘটনাটি মিটিয়ে ফেলতে সালিশে বসেন স্থানীয় মাতবররা। অভিযুক্তের পরিবারকে এক লাখ ২৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হলেও অভিযুক্ত পক্ষ মানেনি। ২য় দফায় শনিবার জরিমানা ৩০ হাজার টাকা পুনর্নির্ধারণ করা হয়েছে! আবার এটিও ভুক্তভোগী পরিবারের লোকজন মেনে না নেওয়ায় উভয়পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করছে।
এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, মানসম্মানের মূল্য তো কোটি টাকা দিলেও হবে না।