নিলামের নামে সিন্ডিকেট, হাতিয়ে নিল সরকারি খামারের ৩৭ গরু
রাজশাহী ব্যুরো
প্রকাশ: ১০ জুন ২০২৪, ০৯:৪৮ পিএম
ছবি: ফাইল
রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার একটি সরকারি খামার থেকে নিলামের নামে সিন্ডিকেট করে নামমাত্র দামে ৩৭টি গরু হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
উপজেলার রাজাবাড়িহাটে আঞ্চলিক দুগ্ধ ও গবাদি উন্নয়ন খামারে এ ঘটনা ঘটে। নিলামে অংশ নিতে মোট ৩৫৭ জন ব্যাংক ড্রাফট (বিডি) জমা দিয়েছিলেন; কিন্তু নিলামে ডাক ধরেছেন মাত্র পাঁচজন। অন্যরা কেউ নিলামে অংশ নেননি।
জেলা কৃষক লীগ নেতা ইমন মণ্ডল এ সিন্ডিকেটের নেতৃত্বে আছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। তারা সোমবার সকালে নামমাত্র দামে খামারের ৩৭টি গরু হাতিয়ে নিয়েছেন।
সরেজমিন দেখা গেছে, নিলামে বড় আকারের একটি ষাঁড়ের ওজন ছিল প্রায় ১২ মণ। খামারের কর্মচারী মহাসিন আলী ডাক ধরেন। সরকারি ডাক ১ লাখ ৩১ হাজার টাকা। ২০০ টাকা বাড়িয়ে ডাক ধরেন তাজমুল নামের নিলামে একজন অংশগ্রহণকারী। এরপর আরও ২০০ টাকা বাড়ান মেহেরাব নামের আরেকজন। সবশেষ কালু আরও ২০০ বাড়িয়ে ১ লাখ ৩১ হাজার ৬০০ টাকায় ষাড়টি কিনে নেন। তবে বর্তমানে কুরবানির হাটে এই ষাঁড়টির দাম অন্তত চার লাখ টাকা। একইভাবে মাত্র ১ লাখ ২৫ থেকে ১ লাখ ৩১ হাজারের কিছু বেশি টাকার মধ্যে আরও তিনটি ষাঁড় পানির দরে বিক্রি করা হয়েছে।
নিলাম চলাকালে দেখা গেছে, খামারের কর্মচারী যে সরকারি দর ঘোষণা করছেন, তার চেয়ে ৬০০ টাকা বেশি দরে প্রতিটি গরু বিক্রি হচ্ছে। নিলামের শর্ত ছিল, প্রতিবার ডাক ধরার সময় সরকারি মূল্য অপেক্ষা ২০০ টাকা করে বেশি বলতে হবে। সে অনুযায়ী সিন্ডিকেটের সদস্যরা ২০০ টাকা করে বেশিই ডেকেছেন। তিনজনে ২০০ করে মোট ৬০০ টাকা বাড়িয়ে গরু কিনে নিচ্ছিলেন। প্রতিটি গরু তিনজনের ডাকা হলে আর অন্য কেউ ডাকছিলেন না। বাধ্য হয়ে ঘোষণা দেওয়া সরকারি দরের চেয়ে মাত্র ৬০০ টাকা বেশি পেয়েই গরু বিক্রি করে কর্তৃপক্ষ।
খামার কর্তৃপক্ষ এ দিন চারটি ষাঁড়, ২১টি এঁড়ে, ১০টি গাভি ও ১৬টি বকনা মিলে মোট ৫১টি গরু নিলামের জন্য তোলে। এরমধ্যে ৩৭টি গরু সিন্ডিকেটে পানির দরে কিনে নেয়। প্রথম দফায় খামার কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে গরু কিনে দুপুরের পর একই স্থানে নিলামের মাধ্যমেই গরু বিক্রি করে এই সিন্ডিকেট। দ্বিতীয় দফার এ নিলামে সাধারণ মানুষ অংশ নিতে পারেন। সিন্ডিকেটের কাছ থেকে বেশি দরে তাদের গরু কিনতে হয়। প্রথম দফার নিলামের মাধ্যমে খামার ও প্রাণিসম্পদ বিভাগের দুই কর্মকর্তা দুটি এঁড়ে কিনে নেন। বাকি ১২টি বকনা কেউ কেনেনি।
নিলামের শুরুতেই ৪৭০ কেজি ওজনের একটি ষাঁড় আনা হয়। ষাঁড়টির সরকারি ডাক হাঁকা হয় ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা। প্রথমেই কালু ষাঁড়ের দর হাঁকেন ১ লাখ ২৫ হাজার ২০০। এরপর তাজমুল ১ লাখ ২৫ হাজার ৪০০ এবং শেষে মেহেরাব ১ লাখ ২৫ হাজার ৬০০ টাকা দর হাঁকেন। এরপর আর কেউ ডাকেননি। এক মিনিটের মধ্যে মেহেরাবের দর ১, ২, ৩ ঘোষণা দিয়ে তার কাছে এ গরু বিক্রি করা হয়। এ সময় উপস্থিত সিন্ডিকেটের প্রায় শতাধিক সদস্য হাততালি দিতে থাকেন।
দ্বিতীয় লটে প্রায় একই ওজনের আরেকটি ষাঁড়ের সরকারি দর হাঁকা হয় ১ লাখ ২০ হাজার টাকা। এরপর সেই তাজমুল, মেহেরাব ও কালু ২০০ টাকা করে বাড়িয়ে ষাঁড়টির দর হাঁকেন। শেষে ১ লাখ ২০ হাজার ৬০০ টাকায় ষাঁড়টি কেনা হয় কালুর নামে। আরেকটি বড় ষাঁড়ের দর হাঁকা হয় ১ লাখ ২৮ হাজার টাকা। আবার সেই মেহেরাব, কালু ও তাজমুল ২০০ টাকা করে বাড়িয়ে দর হাঁকেন। ১ লাখ ২৮ হাজার ৬০০ টাকায় এ ষাঁড়টি কেনা হয় তাজমুলের নামে। মেহেরাব, কালু ও তাজমুলের বাইরে একইভাবে ২০০ টাকা করে দর বাড়িয়ে গরু কিনেছেন উৎসব ও লতিফ। এই পাঁচজনের বাইরে আর কেউ নিলামে অংশগ্রহণ করেননি।
নিলাম চলাকালে দেখা গেছে, কর্মকর্তাদের কাছে থাকা সিডিউলের খাতায় প্রতিটি গরুর ওজন এবং দর লেখা আছে। তবে যে দর লেখা আছে, তার চেয়ে এক থেকে দুই হাজার টাকা করে বেশি ধরে সরকারি দর হাঁকা হচ্ছে। ৮৫ কেজি ওজনের একটি বকনার দর ছিল ২৩ হাজার ৩৭৫ টাকা। এটির দর হাঁকা হয় ২৫ হাজার। ১৩৩ কেজি ওজনের একটি এঁড়ে গরুর দর ছিল ৫৭ হাজার ৭৫০ টাকা। এটির দর হাঁকা হয় ৫৯ হাজার টাকা। ডাকে ৫৯ হাজার ৬০০ টাকায় এটি বিক্রি হয়।
সিডিউলের মূল্য অপেক্ষা বেশি দর হাঁকার বিষয়ে জানতে চাইলে খামারের উপ-পরিচালক ইসমাইল হক বলেন, জীবন্ত গরুর মূল্য ধরা হয়েছে প্রতি কেজি ২৭৫ টাকা। গরুর ওজন নেওয়া হয়েছে দুইমাস আগে। নিলামের প্রক্রিয়া শেষ করতে করতেই প্রায় দুই মাস চলে গেছে। এই সময়ের মধ্যে গরু খামারের খাবার খেয়েছে। একটু বড় হয়েছে। তাই সিডিউল অপেক্ষা এক-দুই হাজার টাকা বেশি দর ধরা হচ্ছে। এ টাকা সরকারি কোষাগারেই জমা হবে।
নিলামের সময় উপস্থিত ছিলেন জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ড. জুলফিকার মো. আখতার হোসেন। সিন্ডিকেট নিয়ে জানতে চাইলে তিনি অসহায়ত্ব প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, খামার থেকে যখনই গরু নিলামে তোলা হয় তখনই সিন্ডিকেট করে এলাকার কিছু লোক গরু কিনে নেন। পরে তারা সেই গরু খামারেই বিক্রি করেন। অন্য কেউ নিলামে অংশ না নিলে তাদের কিছু করার থাকে না। নিলাম বাতিল করলেও লাভ হবে না। যখন নিলাম হবে, তখনই সিন্ডিকেট হবে।
তিনি আরও বলেন, ৩৫৭ জন বিডি জমা দিয়েছেন নিলামে অংশ নিতে; কিন্তু পাঁচজনের বাইরে কেউ ডাকলেন না। এমন নয় যে, কেউ কাউকে ডাকতে বাধা দিয়েছেন। বাধা যেন দিতে না পারে তার জন্য পুলিশ রাখা হয়েছিল কিন্তু তারপরও কেউ ডাকেননি।
এ নিলামের সিন্ডিকেটে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন জেলা কৃষক লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ইমন মন্ডল। কথা বলার জন্য তাকে ফোন করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। এমনকি নিলাম স্থলে তার সাথে কথা বলার চেষ্টা করা হয়; কিন্তু তিনি গণমাধ্যম কর্মীদের সাথে কথা না বলে সেখান থেকে সরে পড়েন।