৩৩ দিনের দুঃসহ স্মৃতি তুলে ধরলেন ক্যাপ্টেন
মজুমদার নাজিম উদ্দিন, চট্টগ্রাম
প্রকাশ: ১৪ মে ২০২৪, ১০:৪৩ পিএম
বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ ভারত মহাসাগরে জলদস্যুদের কবলে পড়ে গত ১২ মার্চ। অস্ত্রের মুখে জিম্মি করা হয় এর ২৩ নাবিককে, যাদের সবাই বাংলাদেশি। মালিকপক্ষের নানামুখী তৎপরতায় ৩৩ দিনের মাথায় ১৩ এপ্রিল মুক্তি মেলে জাহাজ ও নাবিকদের।
মঙ্গলবার বিকালে চট্টগ্রাম বন্দরের জেটিতে নেমেই নাবিকরা বর্ণনা করেন তাদের বন্দিদশার সেই দুঃসহ দিনগুলোর কথা। বিশেষ করে জাহাজের ক্যাপ্টেন মো. আবদুর রশিদের বর্ণনায় জাহাজ জিম্মি হওয়ার মুহূর্তের লোমহর্ষক চিত্র উঠে আসে।
তিনি বলেন, জিম্মি হওয়ার পর আমরা প্রতি মুহূর্তে ছিলাম মৃত্যুঝুঁকিতে। নিরাপদে ফিরতে পারব কখনো ভাবতে পারিনি।
মুক্ত আরও একাধিক নাবিক ভয়ঙ্কর সেই দিনগুলোর কথা তুলে ধরে বলেন, এক অনিশ্চিত অবস্থা থেকে স্বজনদের কাছে ফিরে এসেছি। যেন ফিরে পেয়েছি দ্বিতীয় জীবন। এ আনন্দ ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়।
এমভি আবদুল্লাহর মাস্টার ক্যাপ্টেন আবদুর রশিদ জাহাজ জিম্মি হওয়ার সময়কার চিত্র তুলে ধরে বলেন- প্রথম দিন (১২ মার্চ) যখন আমরা জলদস্যু দ্বারা আক্রান্ত হই, তখন সেকেন্ড অফিসার জাহাজের ব্রিজে ছিলেন। আমি তখন জাহাজের নিচে আমাদের একটা ব্যারাক থাকে সেখানে ছিলাম। তখন জলদস্যুরা সেকেন্ড অফিসারকে ধরে ফেলল। সব কিছু অতি দ্রুত ঘটে গেল। ওরা ৩০-৩৫ মাইল গতিতে স্পিডবোট নিয়ে এলো। আমাদের জাহাজের গতি ১০ মাইল। তাড়াতাড়ি তারা জাহাজে উঠে ব্রিজে চলে এলো।
তিনি বলেন, আমি আর সেকেন্ড অফিসার একটা হিডেন রুমে (সিটাডেল) প্রবেশ করব, নৌবাহিনী এসে উদ্ধার করবে- সেটা আমরা করতে পারিনি। সেকেন্ড অফিসার আটক হওয়ায় আমি গিয়ে দেখি তার দিকে দস্যুরা চারটা একে-৪৭ তাক করে আছে। আমার দিকেও দুইজন অস্ত্র ধরল। আমি হাত তুলে সারেন্ডার করি। পরিস্থিতি তাৎক্ষণিকভাবে ট্যাকল করার জন্য দস্যুদের উদ্দেশে বললাম, উই আর বাংলাদেশি, মুসলিম। আমরা রোজা আছি সেটাও বললাম। এটা বলার পর তারা একটু শান্ত ছিল।
ক্যাপ্টেন বলেন, তারপর সবাইকে ডেকে আনে এক জায়গায়। আমি শক্ত ছিলাম। তাদের সামনে কোনো দুর্বলতা প্রকাশ করিনি। সেকেন্ড অফিসার একটু ভীতসন্ত্রস্ত ছিলেন। ওখানে আমরা সারাদিন সারা রাত ছিলাম। মৃত্যুর ঝুঁকিতে ছিলাম সবাই। আমার নাবিকরা কেউ কেউ কান্না করছিল। তারা আগে কখনো এধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়নি। আমার জীবনেও প্রথম। ভেতরে ভয় কাজ করলেও মুখে এবং অঙ্গভঙ্গিতে সাহসিকতা দেখিয়েছি, যেন তারা আমাদের দুর্বল ভাবতে না পারে। এভাবে ঠাণ্ডা মাথায় পরিস্থিতি সামাল দিয়েছি যাতে আমার ক্রু ও অফিসাররা অক্ষত থাকে, যেন কারো ক্ষতি না হয়। জীবনের নিরাপত্তাটাকে প্রাধান্য দিয়েছিলাম।
ক্যাপ্টেন আবদুর রশিদ আরও বলেন, সোমালিয়ার বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়ে ২৩ জন নাবিক আজকে দেশে ফিরতে পেরেছি। আমাদের দেশের সরকার খুব ভালোভাবে পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছে। আমি নিজেও নিষেধ করেছিলাম যেন কোনো অ্যাকশনে না যায়। তাতে আমাদের ক্ষতি হতে পারত। সবাই সুস্থ ও অক্ষত অবস্থায় ফিরতে পেরেছি। আত্মীয়স্বজনের কাছে আসতে পেরেছি। এটা এমন একটা অনুভূতি যা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।
নাবিক মোশাররফ হোসেন শাকিল তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, পরিবারের সদস্যদের কাছে পেয়ে খুবই ভালো লাগছে। আসলে কী আর বলব। আমরা দ্বিতীয় জীবন পেয়েছি। কখনো পরিবারের সদস্যদের দেখতে পাব- এটা আশা করিনি। আমাদের কোম্পানির প্রতি কৃতজ্ঞ। তাদের চেষ্টা ও দেশবাসীর দোয়ায় অবশেষে ফিরতে পেরেছি। যখন জিম্মি অবস্থায় ছিলাম তখন অবস্থা খুবই করুণ ছিল। পরবর্তীতে সপ্তাহে একদিন কথা বলার সুযোগ দিলেও দুশ্চিন্তামুক্ত কখনই হতে পারিনি।
তিনি বলেন, শারীরিকভাবে তারা যদিও নির্যাতন করেনি কিন্তু সবসময় মানসিক নির্যাতনের মুখে রেখেছিল। ক্যাপ্টেন স্যার আমাদের খুব ভরসা দিতেন, সাহস জোগাতেন। দস্যুদের হাতে সবসময় ভারি অস্ত্র ছিল। সেই অস্ত্র সবসময় তাক করে রাখত।