প্রতিপক্ষ দমনে নারীর ফাঁদ
তালতলীর তনু চেয়ারম্যানকে খুঁজছে পুলিশ
আকতার ফারুক শাহিন ও আব্দুল মোতালিব, তালতলী (বরগুনা) থেকে
প্রকাশ: ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০:৫৭ পিএম
টার্গেট ছিল দুটি-রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমন আর উপজেলা নির্বাচনে সুবিধা নেওয়া। সেই টার্গেটে নিজ দলের নেতাদের বিরুদ্ধে পেতেছিলেন নারীর ফাঁদ। একান্ত মুহূর্তের ভিডিও গোপনে ধারই করে ছড়িয়েছিলেন নেট দুনিয়ায়। তবে শেষে নিজের জালে নিজেই আটকে গেছেন বরগুনার তালতলীর আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক তৌহিদুজ্জামান তনু। উপজেলার ছোট বগি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এই আওয়ামী লীগ নেতাকে এখন হন্যে হয়ে খুঁজছে পুলিশ। ফাঁদে ব্যবহার করা নারী ও তার সহযোগীর স্বীকারোক্তি অনুযায়ী তাকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে জানিয়েছেন তদন্তসংশ্লিষ্টরা। তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে সবটাই ষড়যন্ত্র বলে দাবি করেছে তনু চেয়ারম্যান।
চলতি মাসের মাঝামাঝি তালতলী উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মিনহাজুল আবেদিন মিঠুর একটি আপত্তিকর ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়। তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা হিসাবে ওই উপজেলা ছাত্রলীগের কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করে জেলা ছাত্রলীগ। ছাত্রলীগ নেতার পর একে একে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়ায় স্থানীয় আওয়ামী লীগের আরও দুই নেতার আপত্তিকর ভিডিও। এরা হলেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক পচা কোড়ালিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. আব্দুর রাজ্জাক হাওলাদার ও নিশানবাড়িয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান, ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ড. কামরুজ্জামান বাচ্চু। সাগর পাড়ের শান্ত তালতলীতে এভাবে একের পর আপত্তিকর দৃশ্য ছড়ানোর ঘটনায় হকচকিয়ে পড়া মানুষ হঠাৎ-ই আবিষ্কার করেন, একজন নারীকে কেন্দ্র করেই নেট দুনিয়ায় ছড়াচ্ছে ৩ নেতার ভিডিও। আর তখনই আলোচনার মোড় ঘুরে যায় অন্যদিকে। এরই মধ্যে এ ঘটনায় ডিজিটাল নিরাপত্তা ও পর্নোগ্রাফি আইনে মামলা করেছেন নিশানবাড়িয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান কামরুজ্জামান বাচ্চু। মামলায় প্রতারণার ফাঁদে ফেলে সুকৌশলে ভিডিও ধারণ ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগ আনেন তিনি। এসবের জন্য দায়ী করা হয় ভিডিওতে থাকা তালতলীর-ই বাসিন্দা ইসরাত জাহান লামিয়া (২০) ও তার সহযোগী একই উপজেলার পচাকোড়ালিয়া ইউনিয়নের সাবেক ছাত্রলীগ নেতা জাহিদুল ইসলাম সবুজ (৩০) ফকিরকে।
মামলার প্রেক্ষিতে পুলিশ অভিযান চালিয়ে লামিয়া ও সবুজকে গ্রেফতার করে। এই দুজনের গ্রেফতার হওয়ার মধ্য দিয়েই খুলতে শুরু করে নারীর ফাঁদ পেতে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমন ষড়যন্ত্রের জট। বরগুনা জেলা গোয়েন্দা পুলিশের একটি সূত্র জানায়, জিজ্ঞাসাবাদে পুরো ঘটনার জন্য তনু চেয়ারম্যানকে দায়ী করেছে লামিয়া ও সবুজ। লামিয়া জবানবন্দিতে বলেছেন, ‘সবুজের প্ররোচনা আর মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে ২০২১ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে উল্লিখিত ৩ জনের সঙ্গে প্রেমের অভিনয় করে তাদের ফাঁসানো হয়। পরে ধারণ করা হয় আপত্তিকর ভিডিও। সবুজের চাহিদামতো ভিডিও সরবরাহের পর যোগাযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয় তাদের সঙ্গে। গত বছর বাচ্চু চেয়ারম্যান একদিন ফোন করে লামিয়ার কাছে জানতে চান যে তার সঙ্গে থাকা ভিডিও অন্য লোকের কাছে গেল কি করে। তখন সবুজকে জিজ্ঞেস করলে সে জানায়, তালতলীর তনু চেয়ারম্যানই পেছনে থেকে টাকার বিনিময়ে সবুজ আর আমাকে ব্যবহার করে এসব ভিডিও করিয়েছেন। এলাকায় তনু চেয়ারম্যানের বিপক্ষে থাকা লোকজনকে শায়েস্তা করতেই নাকি তিনি এ পরিকল্পনা করেছিলেন।’ লামিয়ার মতো সবুজও তার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে একই তথ্য দিয়েছেন। পরে ১৬৪ ধারায় এই দুজনের জবানবন্দি নেন বিচারক।
মামলার বাদী কামরুজ্জামান বাচ্চু চেয়ারম্যান বলেন, ‘পুরো বিষয়টাই যে একটা ফাঁদ ছিল সেটা বুঝতে পারি তনু চেয়ারম্যানের হোয়াটস্অ্যাপ থেকে আমার হোয়াটস্অ্যাপে ভিডিও ক্লিপ আসার পর। ওই ভিডিও পাঠিয়ে তনুর কথামতো কাজ করতে এবং না করলে তা ছড়িয়ে দেওয়ায় ভয় দেখানো হয়।’
পরিচয় গোপন রাখার শর্তে ঘটনার শিকার আরেকজন বলেন, ‘নিখুঁত প্রেমের অভিনয় করে একের পর এক নেতাকে ফাঁদে ফেলেন ওই তরুণী। ভালোবাসার অভিনয় করে সে একান্ত মুহূর্তের ভিডিও ধারণ করেন। এরপর হঠাৎ উধাও হয়ে যায়। এর পেছনে দীর্ঘমেয়াদি টার্গেট ছিল তনু চেয়ারম্যানের।’
তালতলী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও উপজেলা চেয়ারম্যান রেজভি উল কবির জমাদ্দার বলেন, ‘যাদের ফাঁদে ফেলে এসব ভিডিও করা হয়েছে, তারা সবাই আওয়ামী লীগের ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতাকর্মী। তাছাড়া এরা সবাই আমার সমর্থক। এবারের উপজেলা নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ঘোষণা দিয়েছেন চেয়ারম্যান তনুর বড় ভাই মনিরুজ্জামান মিন্টু। উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি পদে থাকা এ নেতা গেলবারের নির্বাচনে বিপুল ভোটের ব্যবধানে হেরে যান আমার সঙ্গে। আলোচ্য নেতাদের যে কোনো ভাবে নির্বাচন প্রক্রিয়া থেকে দূরে রাখতে পারলে আমি হারব এবং মিন্টু চেয়ারম্যান হবে-এটাই ছিল তাদের টার্গেট। সেজন্যেই দীর্ঘদিনের পরিকল্পনায় নারীর ফাঁদ পেতে এসব ভিডিও করা হয়েছে।’
বরগুনার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ও ফোকাল পয়েন্ট কর্মকর্তা (মিডিয়া) মোজাম্মেল হোসেন বলেন, ‘গ্রেফতার হওয়া দুই আসামির স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির প্রেক্ষিতে পুরো বিষয়ের তদন্ত চলছে। তালতলী উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী এক নেতা টাকার বিনিময়ে আলোচ্য তরুণীকে ব্যবহার করে এসব ভিডিও তৈরি করেছে বলে জেনেছি আমরা। বিষয়টি যেহেতু এখনো তদন্তাধীন তাই এর বেশি কিছু বলা সম্ভব নয়।’
চেয়ারম্যান তনু বলেন, ‘কেন এবং কি কারণে আমাকে এসবের সঙ্গে জড়ানো হচ্ছে বুঝতে পারছি না। কেউ একজন বললেই কি আমি দোষী হয়ে যাব? আমার বাড়িতে বেশ কয়েকবার পুলিশ গেছে। আমাকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। অথচ এসবের কিছুই আমি জানি না। যাদের ভিডিও ছড়াল, যারা দায়িত্বশীল পদে দায়িত্বে থেকে অন্যায় করল, তারা বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। আর কিছু না করেও আমি আছি পালিয়ে। প্রশাসনের তদন্ত নিয়েও আমার প্রশ্ন রয়েছে। আইনি সমস্যা আমি আইনগতভাবেই মোকাবিলা করব।’