Logo
Logo
×

সারাদেশ

দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মহাসড়কে কোনোভাবেই কমছে না দুর্ঘটনা

Icon

জাহিদ রিপন, ফরিদপুর

প্রকাশ: ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ১১:০০ পিএম

দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মহাসড়কে কোনোভাবেই কমছে না দুর্ঘটনা

দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার সড়ক-মহাসড়কে কোনোভাবেই থামছে না মৃত্যুর মিছিল। ঢাকা-খুলনা ও ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কে অহরহ ঘটছে সড়ক দুর্ঘটনা।

সাধারণ যাত্রী থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট ভুক্তভোগী মহল মনে করছেন, মহাসড়কে থ্রি-হুইলার, ট্রাক-পিকআপে যাত্রী পরিবহণ, ফিটনেসবিহীন গাড়ির অবাধ চলাচল, অদক্ষ চালকের বেপরোয়া গতি, সড়ক সংস্কারের ধীরগতি, প্রশাসনের নজরদারির অভাবের কারণে এসব দুর্ঘটনা ঘটেই চলেছে।

অচিরেই এ সমস্যাগুলো সমাধানের মাধ্যমে সড়ক দুর্ঘটনা কিছুটা হলেও রোধ করা যেতে পারে বলে মনে করছেন সুধী সচেতন মহল ও ভুক্তভোগীরা।

মঙ্গলবার সকাল ৮টার দিকে ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের ফরিদপুর অংশের সদর উপজেলার কানাইপুরের তেতুলতলা নামক স্থানে বাস-পিকআপের মুখোমুখি সংঘর্ষে একই পরিবারের ৪ জনসহ মোট ১৪ জন নিহত হন। দুর্ঘটনায় বাসের যাত্রীরা তেমন একটা আহত না হলেও বিপরীতমুখী পিকআপের ১৪ জন যাত্রী নিহত হন।

এ দুর্ঘটনায় ফরিদপুর জেলা প্রশাসনের তরফ থেকে ৭ সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। হাইওয়ে পুলিশের তরফ থেকে আরেকটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে বলে জানিয়েছেন হাইওয়ে পুলিশ সুপার শাহিনূর আলম খান।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ঢাকা-খুলনা ও ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কে ফরিদপুর-মাদারীপুর রিজিয়নের আওতাধীন ৯৮৭ কিলোমিটার মহাসড়ক রয়েছে। এর মধ্যে ১৮টি থানা ও পুলিশ ফাঁড়ি রয়েছে।

২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত গত দুই বছরে এসব মহাসড়কগুলোতে কমপক্ষে সাড়ে তিনশ টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে নিহতের সংখ্যা চার শতাধিক এবং আহত হয়েছেন প্রায় ৫শ জন।

ফরিদপুর-মাদারীপুর অঞ্চলের আওতাধীন মহাসড়কগুলোতে এসব দুর্ঘটনা ঘটে। এসব মহাসড়কে বেপরোয়া চলাচলকারী বিভিন্ন যানবাহন থেকে হাইওয়ে পুলিশ ও জেলা পুলিশ প্রায় ২০ কোটি টাকার অধিক জরিমানা আদায় করেছে। তারপরও কোনোভাবেই লাগাম টেনে ধরা যায়নি। বিশেষ করে পদ্মা সেতু হওয়ার পর এ মহাসড়ক দিয়ে যানবাহনের চলাচল ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। এই ঈদের আগে ২৪ ঘণ্টায় প্রায় পাঁচ কোটি টাকার টোল আদায় হয়েছে বলে সূত্রে জানা যায়।  

মাদারীপুর রিজিয়ন (হাইওয়ে পুলিশ) কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, এসব মহাসড়কে বেপরোয়া গতিতে ও ট্রাফিক নিয়ম না মেনে যানবাহন চালানোর অপরাধে হাইওয়ে ও জেলা পুলিশ ২০ কোটি টাকার বেশি জরিমানা আদায় করেছে। 

এ বিষয়ে ফরিদপুর জেলা বাস মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদের নেতা গোলাম মোহাম্মদ নাসির জানান, ২২টি জাতীয় মহাসড়কে সব ধরনের অবৈধ থ্রি-হুইলার (নছিমন, করিমন, ভটভটি, মাহিন্দ্র, ব্যাটারিচালিত রিকশা, ইজিবাইক ও ভাড়ায়চালিত মোটরসাইকেল) চলাচল বন্ধের নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও এসব অবৈধ যান মহাসড়কে অবাধে চলাচল করছে। যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।

তিনি বলেন, পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে দক্ষিণাঞ্চলের আঞ্চলিক ও দূরপাল্লায় পরিবহণ চলাচল বৃদ্ধি পেয়েছে। মহাসড়কে অবৈধ যান চলাচলের কারণে প্রতিনিয়ত নানা দুর্ঘটনা ঘটছে। সড়ক দুর্ঘটনার আরেকটি কারণ হলো ত্রুটিপূর্ণ সড়ক ব্যবস্থা। মহাসড়কগুলোতে বাঁক থাকার কারণে সামনের দিক থেকে আসা গাড়ি দেখতে না পেয়ে অনেক চালক দুর্ঘটনা ঘটিয়ে থাকে। রাস্তার পাশে হাট-বাজার স্থাপন এবং ওভারব্রিজ না থাকাও দুর্ঘটনার একটি কারণ।

ফরিদপুর জেলা বাস মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদ নেতা জোবায়ের জাকির জানান, সড়ক দুর্ঘটনার জন্য শুধু চালকরাই যে দায়ী তা কিন্তু নয়, যাত্রী, পথচারী, রাস্তার পাশের দোকান, স্কুল, অনেক সময় বৃদ্ধ-বাচ্চারাও দৌড়ে রাস্তা পার হয়। রাস্তায় অনেক সময় কমগতির থ্রি-হুইলার নসিমন-করিমন-ভটভটি চলে। তাদের মাঝেও সচেতনতা তৈরি করা প্রয়োজন। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ। সরকার, চালক, মালিক, শ্রমিক ও যাত্রী সবাইকে সতর্ক ও সচেতন থাকতে হবে।

সচেতন মহলের অনেকেই মনে করেন, নানা কারণে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। বিশেষ করে চালকের অসাবধানতা-অদক্ষতা ও লাইসেন্সবিহীন অদক্ষ চালক, ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, রাস্তার স্বল্পতা-অপ্রশস্ততা, মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহনের চলাচল, পাল্লা দিয়ে গাড়ি চালানো ও ওভারটেকিং, ট্রাফিক আইন সম্পর্কে অজ্ঞতা ও ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করা, রাস্তার মোড়ে প্রয়োজনীয় ডিভাইডার না থাকা, ওভার ব্রিজের স্বল্পতা, সড়ক ব্যবহারকারীদের মধ্যে অসচেতনতা, ফুটপাত হকারদের দখলে থাকা, দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, সড়কের ওপর অবৈধ হাটবাজার ও স্থাপনা, যত্রতত্র রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি, অতিরিক্ত মাল ও যাত্রীবোঝাই প্রভৃতি। 

নাম প্রকাশ না করে কয়েকজন পরিবহণ চালক জানান, অনেক দুর্ঘটনা ঘটে রাস্তার কারণে। বাধ্য হয়ে দীর্ঘক্ষণ গাড়ি চালানোর কারণেও দুর্ঘটনা হয়। ছোট যানবাহনগুলো আইন না মেনে রাস্তায় এলোমেলো চলাচল করে। তাদের বেপরোয়া চলাচলে দুর্ঘটনা ঘটে। রাস্তার ওপর হাটবাজার, রাস্তায় গাড়ি আছে কিনা, তা না দেখেই পারাপারের প্রবণতার কারণেও দুর্ঘটনা হয়। অথচ দুর্ঘটনা হলে সব দায় চাপানো হয় চালকের ওপর।

ফরিদপুর জেলা পুলিশের ট্রাফিক ইন্সপেক্টর (প্রশাসন) তুহিন লস্কর জানান, ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত ফরিদপুরের আওতাধীন সড়ক-মহাসড়কে চলাচলকারী বিভিন্ন যানবাহনে ৫ হাজার ৫৯৩টি মামলা করা হয়। এর থেকে ১ কোটি ৭২ লাখ ৭৬ হাজার ৮৫০ টাকা জরিমানা আদায় করা হয়। এ ছাড়াও প্রায় ১০ হাজার রেজিস্ট্রেশনবিহীন মোটরসাইকেল জব্দ ও রেজিস্ট্রেশন করা হয়েছে। এতে সরকারের রাজস্ব আয় হয়েছে প্রায় ১০ কোটি টাকা।

হাইওয়ে পুলিশের মাদারীপুর-ফরিদপুর কার্যালয় সূত্র জানায়, মহাসড়কগুলোতে চলাচলকারী বিভিন্ন ধরনের যানবাহনগুলো হাইওয়ে পুলিশ নজরদারিতে রাখে। এ সময় বেপরোয়া চলাচলকারী যানবাহনগুলোকে মামলা ও জরিমানা করা হয়। মাদারীপুর রিজিয়নের আওতাধীন ৯৮৭ কিলোমিটার মহাসড়কের মধ্যে ১৮টি থানা ও পুলিশ ফাঁড়িতে ৩৮টি টহল টিম রয়েছে। এসব টিমের সদস্যরা শিফটিং ভাগ করে রাতদিন ২৪ ঘণ্টা দায়িত্ব পালন করে থাকেন।

ফরিদপুরের করিমপুর হাইওয়ে থানার ওসি মো. সালাউদ্দিন চৌধুরী বলেন, যাত্রীবাহী মঙ্গলবারের কানাইপুরের দুর্ঘটনায় বাসটি ঢাকা থেকে মাগুরার উদ্দেশে যাচ্ছিল। এ সময় দুর্ঘটনায় ১৪ জনের প্রাণহানি ঘটে।

ফরিদপুরের পুলিশ সুপার (এসপি) মোহাম্মদ মোর্শেদ আলম বলেন, মঙ্গলবারের দুর্ঘটনা কবলিত পিকআপভ্যানের চালকের হয়তো কোনো লাইসেন্সই ছিল না। এজন্য যখন কেউ কোনো পরিবহণে উঠবেন, নিজের দায়িত্বশীলতা থেকেই জেনে নিবেন, গাড়িটি উপযোগী কিনা কিংবা চালকের বৈধতা আছে কিনা।

ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক (ডিসি) মো. কামরুল আহসান তালুকদার বলেন, ফরিদপুরে মঙ্গলবার ১৪ জন নিহতের ঘটনায় জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সাত সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। একই সঙ্গে নিহতদের প্রত্যেকের পরিবারকে পাঁচ লাখ টাকা এবং আহতদের প্রত্যেককে তিন লাখ টাকা করে সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া হবে। এছাড়া তদন্ত কমিটির রিপোর্ট দেওয়ার পর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম