রংপুরে আইআরডিপির প্রতারণার ফাঁদ, ডিবির অভিযানে আটক ৯
মাহবুব রহমান, রংপুর ব্যুরো
প্রকাশ: ১৮ মার্চ ২০২৪, ১০:৫২ পিএম
অবশেষে রংপুর নগরীতে আইআরডিপি (ইন্টিগ্রেটেড রুরাল ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম) অফিসে ডিবি পুলিশ অভিযান চালিয়ে ৯ জনকে আটক করেছে। তাদের ডিবি পুলিশের সেন্ট্রাল রোড কার্যালয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
সরকারের মনোগ্রাম (লোগো) ব্যবহার করে নানা প্রকল্পের নামে রহস্যজনক প্রতারণার ফাঁদ পেতেছিল ওই সংস্থাটি। এ রকম তথ্যের ভিত্তিতে এনএসআই (জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা) ও ডিবি পুলিশ সংস্থাটির কার্যালয়ে সোমবার সন্ধ্যায় পূর্বে এ অভিযান চালায়।
এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন ডিবি পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার শাহ নুর আলম পাটওয়ারী।
যুগান্তরে গত ১৩ মার্চ প্রকাশিত ‘প্রতারণার ফাঁদ পেতেছে আইআরডিপি, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার নজরদারি নেই’ শিরোনামে একটি খবর প্রকাশিত হয়। রংপুর মহানগর পুলিশের কমিশনার মো. মনিরুজ্জামানের নির্দেশে আইআরডিপির কার্যক্রম সম্পর্কে অনুসন্ধানে কাজ শুরু করে পুলিশের ওই দুটি গোয়েন্দা সংস্থা।
পুনরায় ১৫ মার্চ ‘আইআরডিপি’র প্রতারণা অনুসন্ধানে গোয়েন্দা পুলিশ’ শিরোনামে খবর প্রকাশিত হলে এনএসআই (জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা) এ নিয়ে পৃথক তদন্ত শুরু করে। তাদের অনুসন্ধানে যুগান্তরে প্রকাশিত খবরের সত্যতা মেলে।
অবশেষে সোমবার ওই দুটি গোয়েন্দা সংস্থা প্রতিষ্ঠানটির গোমস্তাপাড়া কার্যালয়ে অভিযান চালায় বিকালে ৫টায়। প্রায় এক ঘণ্টা ধরে অভিযান চালিয়ে সেখান থেকে সরকারের মনোগ্রাম ব্যবহৃত একাধিক নথিপত্র, ভুয়া দরপত্র, বিভিন্নজনের কাছ থেকে প্রতারণা করে আদায়কৃত নগদ অর্থ সংগ্রহের নথিপত্রসহ বিপুল পরিমাণ দলিলপত্র জব্দ করে।
এ সময় অফিস থেকে প্রদীপ রায়, গোলজার মিয়া, প্রদীপ কুমার আচার্য, মাহবুব হাসান মিলন, নজরুল ইসলাম, রিয়াদ হেসেন, ফজলে রাব্বি, সাজ্জাদ হোসেন ও আলমগীর হোসেন নামে ৯ জনকে আটক করে ডিবি পুলিশ। তাদের বিরুদ্ধে মামলার প্রস্তুতি চলছে।
এ সময় সংস্থার প্রধান নির্বাহী মোস্তফা কামাল রাসেল অফিসে থেকে পালিয়ে যাওয়ায় তাকে গ্রেফতার করতে পারেনি ডিবি পুলিশ।
যুগান্তরের অনুসন্ধানে জানা গেছে, সংস্থাটির প্রধান নির্বাহী মোস্তফা কামাল রাসেলের বিরুদ্ধে দুটি মামলার গ্রেফতারি পরোয়ানা রয়েছে। বিস্ময়কর বিষয় দুটি মামলার গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি থাকার পরও কী করে রংপুর কোতোয়ালি থানা থেকে কোয়ার্টার কিলোমিটার দূরে আইআরডিবি সংস্থাটি অফিস খুলে মোস্তফা কামাল রাসেল পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে সেখানে এমন প্রতারণার ফাঁদ পেতেছিল। এ নিয়ে অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।
ইতোপূর্বে যুগান্তরে প্রকাশিত খবরে বলা হয়, সংস্থাটি মাত্র ১০ লাখ টাকা পুঁজি নিয়ে ১০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে তাদের ১৭টি প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ শুরু করেছে। ওই টাকার জোগান তারা সেবাপ্রার্থী ও সহযোগী সংগঠনগুলোর কাছ থেকে সংগ্রহ করবে- এমন তথ্য নিশ্চিত করেছেন সংস্থাটির একাধিক কর্মকর্তা।
শুধু তাই নয় ক্ষমতাসীন দলের একাধিক সংসদ সদস্য, কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতাদের প্রশ্রয়ে রংপুর নগরীতে আইআরডিপি (ইন্টিগ্রেটেড রুরাল ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম) নামে প্রতিষ্ঠানটি কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে এমন তথ্য মিলেছে। তাদের কার্যক্রমের সঙ্গে কয়েকজন সংসদ সদস্য ও দলের নেতা যুক্ত আছেন বলে ওই সংস্থার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোস্তফা কামাল রাসেল এই প্রতিবেদককে জানিয়েছেন।
এছাড়া তিনি আরও জানিয়েছেন, গাইবান্ধা, ঠাকুরগাঁও, কুড়িগ্রাম জেলার ফুলবাড়ি, দিনাজপুর, পঞ্চগড়সহ একাধিক জেলার একাধিক সরকার দলীয় সংসদ সদস্যসহ আওয়ামী লীগের স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় পর্যায়ে একাধিক নেতা তাদের এই কাজের সঙ্গে যুক্ত। তারা তাদের কর্মসূচি সফল করা জন্য বিভিন্ন পর্যায়ে যুক্ত আছেন। তাদের অনেকেই ইউনিয়ন ও উপজেলা পর্যায়ে তাদের কমিউনিটি ক্লিনিক ও হেলথ সেন্টার নির্মাণের জন্য দরপত্রে অংশ গ্রহণ করেছেন। অনেকে নির্মাণ কাজ শুরু করেছেন। নির্মাণ কাজের জন্য সংস্থাটির পক্ষে দরপত্রে অংশগ্রহণকারী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে দরপত্র অনুযায়ী কার্যাদেশ দেয়ার জন্য উৎকোচ হিসেবে ১৫ লাখ টাকা, জামানত হিসেবে ৫ লাখ টাকা ও দরপত্র ক্রয়ের জন্য ৪ হাজার টাকা গ্রহণ করেছেন বলে স্বীকার করেছেন সংস্থার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা।
সেই হিসাব অনুযায়ী রংপুর বিভাগের ৮ জেলার ইউনিয়ন ও উপজেলা পর্যায়ে ৫৩৫টি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স নির্মাণের জন্য তাদের নির্ধারিত নির্মাণ ব্যয় বাবদ প্রতিটির বরাদ্দ ৮৪ লাখ টাকা হলে নির্মাণ ব্যয় দাঁড়াবে মোট ৪৫৯ কোটি ৪০ লাখ টাকা।
মাত্র ১০ লাখ টাকা মূলধন নিয়ে কি করে এই বিপুল সংখ্যক টাকার ঠিকাদারি বিল পরিশোধ করা হবে- এমন প্রশ্নের কোনো উত্তর দিতে পারেননি সংস্থার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও হেলথ কমপ্লেক্স নির্মাণ প্রকল্পের পরিচালক মোস্তফা কামাল রাসেল।
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ঠিকাদারি নির্মাণ কার্যাদেশ দেওয়ার নাম করে প্রতিটির বিপরীতে ১৫ লাখ টাকা মোট ৮০ কোটি ২৫ লাখ কি কারণে নেওয়া হচ্ছে এর কোনো সন্তোষজনক জবাব দিতে পারেননি ওই প্রকল্প পরিচালক। তবে তিনি বলেছেন, এভাবে তারা সংগঠনের অভ্যন্তরীণ তহবিল হিসেবে পুঁজি সংগ্রহ করছেন। নির্মাণ কাজের বিপরীতে জামানত বাবদ ২৬ কোটি ৭৫ লাখ টাকা সংগ্রহ করা হয়েছে।
সংস্থাটি সম্পর্কে অনুসন্ধানে আরও উদ্বেগজনক তথ্য পাওয়া গেছে। নথিপত্রে দেখা যায়, ২০০৭ সালে এই প্রতিষ্ঠানটি প্রাথমিক পর্যায়ে গাইবান্ধা জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের মাধ্যমে ঢাকা সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে নিবন্ধনকৃত। সেখানে প্রতিষ্ঠানের নাম লেখা রয়েছে ‘আদর্শ যুব কর্মসংস্থা’ (এজেকেএস), ঠিকানা লেখা রয়েছে গাইবান্ধা জেলার ফুলছড়ি উপজেলার কালিবাড়ী বাজার। তাদের শুধু গাইবান্ধা জেলায় কার্যক্রম পরিচালনার কথা ওই নিবন্ধনে লেখা রয়েছে।
এরপর সংস্থাটি নাম পরিবর্তন করে ২০১১ সালে ‘আদর্শ যুব কর্মসংস্থা ফাউন্ডেশন’ জয়েন্ট স্টক কোম্পানি অ্যান্ড ফার্ম কর্তৃক নিবন্ধন করে।
উল্লেখ্য, ফাউন্ডেশনের নামে নিবন্ধন নিয়ে কোনো লাভজনক কাজ করা যায় না। এটি একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন।
সমাজসেবা আইন ১৯৬১ সালের স্বেচ্ছাসেবী সমাজকল্যাণ সংস্থা সমূহ (নিবন্ধন ও নিয়ন্ত্রণ) অনুযায়ী ৪৬ নম্বর অধ্যাদেশের আওতায় সমাজসেবা অধিদপ্তর নিবন্ধন দিয়ে থাকে। সেখানে স্পষ্ট করে উল্লেখ রয়েছে নিবন্ধনকৃত নামের কোনো পরিবর্তন ও এলাকার বাইরে কার্যক্রম পরিচালনা করা হলে সে নিবন্ধন বাতিল হয়ে যাবে। এর পরও কী করে সংস্থাটি তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছিল তা রহস্যজনক।