উত্তরের সড়ক-মহাসড়কে পণ্যবাহী ট্রাকে বেপরোয়া চাঁদাবাজি
আনু মোস্তফা, রাজশাহী ব্যুরো
প্রকাশ: ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৮:২৪ পিএম
ফাইল ছবি
রাজশাহীসহ উত্তরাঞ্চলের সড়ক ও মহাসড়কগুলোতে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে চাঁদাবাজ সিন্ডিকেট। শ্রমিক ইউনিয়নের নামে-বেনামে চলতি যানবাহন আটকে প্রতিদিনই তোলা হচ্ছে বিপুল টাকা। কখনো বা এলাকার প্রভাবশালী ব্যক্তিদের নামে আবার কখনো ভুঁইফোড় সংস্থার নামে পণ্যবাহী যান থেকে নেওয়া হয় চাঁদা।
অনেক ক্ষেত্রে চাঁদা না দিলে পরিবহণ চালককে মারধরও করা হচ্ছে। এভাবেই উত্তরের সড়কে সড়কে ট্রাকে চাঁদা গুনতে হচ্ছে ব্যবসায়ীদের। আর এ কারণে বাজারে গিয়ে দাম বাড়ছে বিভিন্ন পণ্যের।
এদিকে টার্মিনালের ভেতরেও বাইরে শ্রমিক সংগঠনগুলোর চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ পরিবহণ মালিকরাও। মালিকরা বলছেন কোনোভাবেই এদের নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে। তবে সরকারের উচ্চপর্যায়ের নির্দেশনার পর সড়ক মহাসড়কে পণ্যবাহী বাহনে চাঁদাবাজি বন্ধে মাঠে নেমেছে র্যাব।
উত্তরের রাজশাহী, নাটোর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁসহ কয়েকটি জেলায় চলছে র্যাবের বিশেষ অভিযান। এরই মধ্যে সড়কে চাঁদাবাজির অভিযোগে ৫২ জনকে গ্রেফতার করেছে র্যাবের অভিযানিক দল।
রাজশাহীস্থ র্যাব-৫ এর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন সড়ক মহাসড়কে পণ্যবাহী যান আটকে চাঁদাবাজির ঘটনা বেড়েছে। তবে র্যাবের অভিযান শুরুর পর গত দুই সপ্তাহে উত্তরের আটটি স্পটে চাঁদা তোলা বন্ধ হয়েছে। তারা জনস্বার্থে আরও অভিযান করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজশাহী মহানগরীর উপকণ্ঠ খড়খড়িতে দেশের অন্যতম বৃহৎ সবজি মোকাম। ভোর থেকে সকাল ১০টার মধ্যে চলে কেনাবেচা। এখান থেকে রাজশাহীর নানা ধরনের সবজি চলে যায় ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলার পাইকারি মোকামে।
এ হাট থেকে নিয়মিত পণ্য বহনকারী ট্রাকের চালক মোস্তাকিম হোসেন বলেন, খড়খড়ি থেকে ঢাকা পর্যন্ত সড়কের বিভিন্ন মোড়ে প্রকাশ্যে ট্রাক থেকে চাঁদা তোলা হয়। পরিবহণ শ্রমিক সংস্থার নামের স্লিপে যদি ৪০ টাকা লেখা থাকে আদায় করা হয় ৪০০ টাকা। এভাবে ঢাকা পর্যন্ত যেতে একটি পণ্যবাহী ট্রাককে দিতে হয় ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা।
মাছ বহনকারী ট্রাকচালক হেদায়েত হোসেন বলেন, সড়কে চাকা গড়ালেই চাঁদা দিতে হয়। চাঁদা না দিলে ট্রাকের চাবি কেড়ে নেয়। পুলিশ সার্জেন্টরা নিকট দূরত্বে অবস্থান করে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেন। এভাবে গোটা উত্তরাঞ্চলের সড়ক মহাসড়কে শতাধিক পয়েন্টে প্রকাশ্যে চাঁদা তোলা হয়ে আসছে।
রাজশাহীর পণ্যবাহী ট্রাকের একাধিক চালকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আন্তঃজেলা ট্রাক পরিবহণ শ্রমিক ইউনিয়ন, জেলা ট্রাক ট্যাংক লরি, কাভার্ডভ্যান মালিক সমিতি এবং বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ শ্রমিক ফেডারেশন রাজশাহী বিভাগীয় আঞ্চলিক কমিটি, উত্তরবঙ্গ পরিবহণ শ্রমিক সংস্থার নামে মহাসড়কে ট্রাক থেকে প্রতিদিন লাখ লাখ টাকা আদায় করা হয়। দিনে ট্রাকপ্রতি ৭০ টাকা আর রাতে হলে নেওয়া হয় ১০০ টাকা। যারা সড়কে চাঁদা তোলেন তাদের অধিকাংশই শ্রমিক নয়। তারা ভুঁইফোড় শ্রমিক সংগঠনের নামে শুধুই চাঁদাবাজ।
জানা গেছে, উত্তরাঞ্চল থেকে প্রতিদিন বঙ্গবন্ধু সেতু ও লালনশাহ সেতু হয়ে সারা দেশে ১৫ হাজার পণ্যবাহী যানবাহন চলাচল করে। প্রতিটি ট্রাক থেকে ৩৭০ টাকা করে চাঁদা তোলা হয়। সেই হিসাবে শুধু ট্রাক থেকেই প্রতি মাসে কয়েক কোটি টাকা চাঁদা উঠছে।
বাংলাদেশ ট্রাক-কাভার্ডভ্যান পণ্য পরিবহণ মালিক অ্যাসোসিয়েশনের কেন্দ্রীয় ভাইস প্রেসিডেন্ট সাদরুল ইসলাম বলেন, সড়কে শ্রমিকদের চাঁদাবাজিতে আমরাও অতিষ্ঠ। শ্রমিক নেতাদের বারবার বলেও কাজ হয় না। বাধ্য হয়ে আমরা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে অভিযোগও করেছি। যাতে পণ্যবাহী ট্রাকে ও কাভার্ডভ্যানে কোনো ধরনের চাঁদাবাজি না হয়। কারণ এর প্রভাব গিয়ে বাজারে পড়ছে। এই চাঁদাবাজির দায়ভার আমরা নিতে চাই না। এই চাঁদাবাজির পরিবহণ শ্রমিক নেতারাই জড়িত।
র্যাবের সংশ্লিষ্ট সূত্রের দেওয়া তথ্যমতে, গত দুই সপ্তাহে রাজশাহী, জয়পুরহাট, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নাটোরের বিভিন্ন সড়ক ও ট্রাক টার্মিনালে অভিযান চালিয়ে চাঁদার রশিদ বই, নগদ অর্থ, লাল ঝাণ্ডা ও লাঠিসহ ৫২ জনকে আটক করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির মামলা করে সংশ্লিষ্ট থানায় হস্তান্তর করা হয়েছে।
র্যাব সূত্র জানায়, গত ১১ ফেব্রুয়ারি রাজশাহীর তানোর মোড়ে সড়কে যানবাহনে চাঁদাবাজির সময় অসীম আলীসহ ৪ জনকে হাতেনাতে আটক করে র্যাব। গত ৭ ফেব্রুয়ারি র্যাব-৫ এর একটি দল চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার আমনুরা সড়কে অভিযান চালিয়ে পরিবহনে চাঁদাবাজির অন্যতম হোতা রফিকুল ইসলামসহ তিনজনকে আটক করেছে। এর আগে গত ৬ ফেব্রুয়ারি একই এলাকা থেকে আটক করা হয় আরও দুজনকে।
গত ৫ ফেব্রুয়ারি নাটোরে পৃথক অভিযান চালিয়ে আটক করা হয় ২৫ জনকে। একই দিন জয়পুরহাট জেলার কলাবাজার এলাকা থেকে পণ্যবাহী ট্রাকের গতিরোধ করে চাঁদাবাজির সময় নগদ টাকা ও সরঞ্জামসহ একজনকে আটক করা হয়। এ ছাড়াও রাজশাহীর বাঘা উপজেলার বঙ্গবন্ধু মোড়ে সিএনজি অটোরিকশা স্ট্যান্ড এলাকা থেকে গত ৭ ফেব্রুয়ারি কাঁচামালবোঝাই ট্রাক, সিনএনজি অটোরিকশা ড্রাইভারদের গতিরোধ করে চাঁদাবাজি চক্রের মূল হোতা আরমান ওরফে রানাসহ চারজনকে আটক করে র্যাব।
গত ৪ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী নগরীর শাহমখদুম ট্রাক টার্মিনালে অভিযানে চাঁদাবাজ চক্রের অন্যতম হোতা আক্তারুজ্জামান হেলেনসহ চারজনকে আটক করা হয়। একইদিন নগরীর কাটাখালী বাসস্ট্যান্ডে অভিযান পরিচালনা করে আশরাফুল ইসলামসহ তিনজনকে আটক করে র্যাব। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ সংঘবদ্ধ এই চাঁদাবাজ চক্রটি লাঠিসোটা নিয়ে মহাসড়কে চলাচলকারী যাত্রীবাহী বাস, পণ্যবাহী ট্রাক, লেগুনা, হিউম্যান হলারসহ বিভিন্ন ধরনের যানবাহন আটকে চালকদের ভয়ভীতি দেখিয়ে মোটা অঙ্কের চাঁদা আদায় করত। চাঁদা না পেলে তারা গাড়ি ভাঙচুর করছিল। এছাড়া চালকদের আটকে রেখে মারধরও করে আসছিল তারা।
অন্যদিকে মহাসড়কে পরিবহণে চাঁদাবাজির কথা স্বীকার করে রাজশাহী জেলা ট্রাক, ট্যাঙ্ক-লরি ও কাভার্ডভ্যান শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলাম নুরু বলেন, র্যাবের চলমান অভিযানের কারণে আপাতত চাঁদা তোলা বন্ধ আছে। আমাদের ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে আলোচনা চলছে। এখন দেখি তারা কী সিদ্ধান্ত দেন।
এদিকে শুধুমাত্র পণ্যবাহী ট্রাকেই নয়, উত্তরাঞ্চলের মহাসড়কজুড়ে চাঁদাবাজি চলে যাত্রীবাহী বাসেও। বিভিন্ন জেলা ও উপজেলার সড়কের মোড়ে মোড়ে ও গুরুত্বপূর্ণস্থানে চাঁদা তোলেন শ্রমিকরাই। এ নিয়ে বাস মালিক ও শ্রমিকদের মাঝেও দ্বন্দ্ব রয়েছে।
গাইবান্ধার পলাশবাড়িতে বাস আটকে চাঁদাবাজির অভিযোগে গত ১৮ জানুয়ারি রাজশাহী-রংপুর রুটে বাস চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। রাজশাহী বিভাগীয় সড়ক পরিবহণ মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আমিনুল ইসলামের অভিযোগ করে বলেন, গাইবান্ধার পলাশবাড়ীতে স্থানীয় মালিক সমিতির নামে কুড়িগ্রাম থেকে আসা বাসগুলো থেকে চাঁদাবাজি করা হচ্ছিল। এর প্রতিবাদে কুড়িগ্রাম-রংপুরের বাস বন্ধ করা হয়। ওই সময় এর সঙ্গে একাত্মতা জানিয়ে রাজশাহী বিভাগের কোনো বাস রংপুর বিভাগে চলাচল না করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
রাজশাহী সড়ক পরিবহণ মালিক গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক মতিউল ইসলাম টিটো বলেন, আমরা মালিকরাও সড়কে চাঁদাবাজির বিপক্ষে। পরিবহণ সংক্রান্ত যে কোনো সভা-সমিতিতে আমরা এর বিরুদ্ধে বলে থাকি। সড়ক মহাসড়ক থেকে চাঁদাবাজ উচ্ছেদে র্যাবের যে অভিযান চলছে তাকে আমরা স্বাগত জানিয়েছি।
রাজশাহী জেলা মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মাহাতাব হোসেন বলেন, মালিক ও শ্রমিক সংগঠনগুলোর যৌথ সিদ্ধান্তেই সংগঠনের কল্যাণ ব্যয় মেটাতেই চাঁদা তোলা হয়। শ্রমিকদের কল্যাণেই এ টাকা ব্যয় করা হয়। এটা অবৈধ নয়। এটা নতুন ঘটনা নয়।
সড়ক মহাসড়ক থেকে চাঁদাবাজি উচ্ছেদে র্যাবের চলমান অভিযান প্রসঙ্গে রাজশাহী র্যাব-৫ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল মুনীম ফেরদৌস বলেন, আমরা সড়কে চাঁদাবাজি বন্ধ করতে চাই। রাজশাহী অঞ্চলজুড়ে র্যাবের বিশেষ অভিযান চলছে। চাঁদাবাজদের যেখানে পাওয়া যাবে আমরা তাদের গ্রেফতার করব। বিশেষ করে পণ্যবোঝাই বাহনে চাঁদাবাজির দোহাই দিয়ে দ্রব্যমূল্য বাড়ানো হচ্ছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তি ও সংগঠনের নাম ব্যবহার করে তারা চাঁদাবাজি করেন। পরিবহণ শ্রমিক সংগঠনের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, তারা ৬০ টাকা আদায় করেন। এই অর্থ আদায়েরও কোনো ভিত্তি নেই। আমরা দেখছি পণ্যবোঝাই ট্রাক থেকে ২৫০ থেকে ৪৫০ টাকা আদায় করা হয়। এমনকি বিভিন্ন জায়গায় ইজারা দেওয়ার নামে সড়কজুড়ে যেকোনো পরিবহণ থেকে টাকা আদায় করা হচ্ছে। সড়কে কোনো ধরনের অবৈধ চাঁদাবাজি চলতে দেওয়া হবে না।