নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতা, সন্দ্বীপে বাড়িছাড়া স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থকরা

সন্দীপ সংবাদদাতা
প্রকাশ: ১৩ জানুয়ারি ২০২৪, ১১:১৮ পিএম

চট্টগ্রামের সন্দ্বীপে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন পরবর্তী হামলা, সহিংসতা অব্যাহত রয়েছে। ভয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থীর শত শত সমর্থক বাড়িঘর ছেড়ে চট্টগ্রামে পাড়ি জমিয়েছেন। মামলা দিয়ে ৩৬ জনসহ অজ্ঞাত ৬০/৭০ জনকে আসামি করে এ সহিংসতা আরও উসকে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। এ অবস্থায় জরুরি বিবেচনায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে সন্দ্বীপে। শুক্রবার থেকে চট্টগ্রাম জেলা গোয়েন্দা পুলিশের একাধিক টিম সন্দ্বীপে অভিযান শুরু করেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, এসব অভিযানে এ পর্যন্ত বেশ কয়েকজন সন্ত্রাসী ও নৌকা সমর্থককে গ্রেফতার করলেও ওপরের মহলের চাপে তাদের অনেককে আবার ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এসব কারণে সন্দ্বীপজুড়ে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে।
নির্বাচনের পরদিন বিজয় মিছিল থেকে এমপি মাহফুজুর রহমান মিতা জানান, কোনো ধরনের সহিংতার দায়িত্ব নেবেন না। নেতাকর্মীদের হুঁশিয়ার করলেও থেমে নেই হামলা। ইতোমধ্যে বিভিন্ন ইউনিয়নে কয়েকশ হামলা ও বাড়িঘর ছেড়ে দেওয়াসহ নানা ধরনের ঘটনা ঘটেছে। স্থানীয় ছাত্রলীগ, যুবলীগসহ নৌকার সমর্থকরা এখন স্বতন্ত্র প্রার্থীর নেতাকর্মীদের বিচার করছেন। এসব বিচারে কাউকে কান ধরে ওঠবস করানো, কাউকে কনকনে ঠাণ্ডার মধ্যে পানিতে ডুবিয়ে রাখা, জামাকাপড় খুলে বাজারে বাজারে কান ধরে ঘুরানোর মতো কথিত সাজা দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ আছে।
নির্বাচনের দিন সন্ধ্যায় উপজেলার কালাপানিয়ার নামারবাজার এলাকায় তৈয়ব মেম্বারের বাড়িতে ঈগল সমর্থক তৈয়ব মেম্বারের ছেলের ওপর সন্ত্রাসী হামলা হয়। জরুরি সেবা ৯৯৯-এ কল করে এমন অভিযোগ করা হয়। পরদিন সোমবার সন্তোষপুরের ৮নং ওয়ার্ডের ঈগল সমর্থক শাহদাতের ভাই ও মায়ের ওপর সন্ত্রাসী হামলা হয়। পুলিশ গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে। একই দিন মাইটভাঙ্গা চৌধুরী বাজার এলাকায় ঈগল সমর্থক কয়েকটি হিন্দু বাড়িতে হামলার খবর পাওয়া গেছে।
এমন সহিংসতার ঘটনায় অভিযান পরিচালনা করে চট্টগ্রাম জেলা ডিবি পুলিশের একটি টিম। শুক্রবার রাত থেকে পরিচালিত অভিযানে গ্রেফতার হয় দুজন। তারা হলেন- রহমতপুর ইউনিয়ন পরিষদের ৭নং ওয়ার্ডের সদস্য জামাল উদ্দিন ও সারিকাইতের সোলাইমান মেহেদী। জামাল উদ্দিনকে নির্বাচনের আগে গত ২২ ডিসেম্বরের আলী মিয়া বাজার এলাকার সহিংসতার ঘটনায় ও সোলেমান মেহেদীকে শুক্রবার সারিকাইতের সহিংসতার ঘটনায় গ্রেফতার দেখায় পুলিশ।
সহিংসতা বন্ধে ডিবি পুলিশের টিম সন্দ্বীপ থানা পুলিশের চিহ্নিত সন্ত্রাসী, পুলিশ হত্যা প্রচেষ্টা মামলার আসামিদের বাড়ি ও অফিসে অভিযান চালায়। অভিযানে তাদের নিকটাত্মীয়দের মাধ্যমে সহিংসতা বন্ধে কঠোর পদক্ষেপের হুঁশিয়ারি দেয়।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম জেলা ডিবি পুলিশের ওসি নূর আহমেদ জানান, অভিযান অব্যাহত থাকবে। কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, স্বতন্ত্র প্রার্থীর পোলিং এজেন্ট হওয়ায় শিপন নামে এক যুবককে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় রহমতপুর তালতলি বাজারে বেদম মারধর করা হয়। স্থানীয় জামাল মেম্বারের নেতৃত্বে একদল সন্ত্রাসী তাকে মারধর করে কান ধরিয়ে পুরো বাজারে ঘুরায় বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ওইদিন সন্ধ্যায় ওই ইউনিয়নের আদম খাঁ পাড়ার এক হিন্দু যুবককে ধরে নিয়ে পুকুরে ফেলে দেয় রুবেল নামে স্থানীয় এক সন্ত্রাসী। রুবেল ইউনিয়ন যুবলীগ কর্মী। ওই যুবককে এক ঘণ্টা পানিতে দাঁড় করিয়ে রেখে পরে কান ধরে ওঠবস করানো হয়। এরপর ১০ হাজার টাকা জরিমানা নেন রুবেল।
এর চেয়ে ভয়াবহ ঘটনা ঘটেছে মগধরা ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডে। সেখানে স্বতন্ত্র প্রার্থীর প্রধান এজেন্ট আব্দুল হান্নানসহ ৭ জনের ওপর ভোটের দিন রাতে হামলা করে স্থানীয় ওয়ার্ড মেম্বার রাকিব জাহাঙ্গীর ও তার দলবল। পরের দিন স্থানীয় তহসিলদার বাড়ির চার ব্যবসায়ীর দোকান বন্ধ করে দেওয়া হয়। এমনকি তহসিলদার ও মালাদার বাড়ির লোকজনের কাছে যেন পণ্য বিক্রি করা না হয়-এমন আদেশ দেন রাকিব জাহাঙ্গীর।
সারিকাইত ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ডের আরিফ ওরফে মোচওয়ালা আরিফ ও পাকা মসজিদের সুমনসহ আরও ২০-৩০ জন সন্ত্রাসীর নেতৃত্বে ওই এলাকার কাজী নাছিরের ওপর হামলা হয়েছে। সন্ত্রাসী হামলার ভয়ে মাইটভাঙ্গা ইউনিয়ন যুবলীগ সাধারণ সম্পাদক আইনুল কবির মুন্না বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। স্থানীয় তছলিমের নেতৃত্বে তার বাড়িঘরে হামলা করা হয় বলে অভিযোগ আছে। আদর্শপাড়া এলাকায় সম্ভু জলদাসের ওপরে হামলার ঘটনা ঘটেছে। জানা গেছে, মগধরা ৮নং ওয়ার্ডের বর্তমান মেম্বার দুলালের নেতৃত্বে জলদাস পাড়ায় হামলা করা হয় নির্বাচনের পর দিন।
মগধরা ৭নং ওয়ার্ড নোয়ার হাট এলাকায় সমীর বাহিনীর প্রধান সন্ত্রাসী জাহাঙ্গীর মেম্বারের নেতৃত্বে ঈগল প্রতীকের কর্মী সমর্থকদের ওপরে হামলা হয় নির্বাচনের পর দিন থেকে। যারা ঈগল প্রতীকের এজেন্ট ছিলেন তাদের ব্যবসায়ীক প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার নির্দেশ দেন জাহাঙ্গীর মেম্বার। অনেকের বাড়িতে বাড়িতেও হামলার ঘটনা ঘটেছে এখানে।
আজিমপুরে রাশেদ মেম্বার, তার ভাই হানিফ এবং ওই এলাকার স্বতন্ত্র প্রার্থীর কর্মী নোয়াব ও কবির নির্বাচনের পর থেকে বাড়িছাড়া। তাদের বাড়িতে গিয়ে সন্ত্রাসীরা হুমকি দিয়েছে বলে অভিযোগ আছে। সন্ত্রাসীরা হুমকি দিয়ে বলেছে, তারা যেন আর বাড়িতে না ঢুকে। আজিমপুরের চৌকিদার নুরছাপা দরবেশকে পোশাক জমা দিয়ে দিতে বলেছে একজন চেয়ারম্যান। তাকে চাকুরিচ্যুত করার হুমকি দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ আছে। কারণ হিসাবে জানা গেছে, নুরছাপা চৌকিদার স্বতন্ত্র প্রার্থীর নির্বাচন করেছেন। আজিমপুরে সোহরাব মেম্বারের বাড়িতেও হামলা হয়েছে ওই চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে। মুছাপুর শুকনা দিঘীর পশ্চিমপাশে লম্বা দাইয়ার বাড়ির এক বৃদ্ধর ওপর হামলা করেছে ওই ওয়ার্ডের বর্তমান মেম্বার সেলিমের ভাইয়ের ছেলে সাহেদ। গাছুয়া ইউনিয়নে সোহেল মেম্বারের বাড়িতে সন্ত্রাসী হামলা চালানো হয় বর্তমান চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে।
সন্তোষপুর ৩ নং ওয়ার্ডের মেম্বার আশ্রাফের ঘরে ঢুকে সন্ত্রাসীরা হামলা করেছে বলে অভিযোগ আছে। ওই হামলায় আশ্রাফ মেম্বার ও তার স্ত্রী আহত হন বলে জানা গেছে। সন্ত্রাসীরা ওই ইউনিয়নের ৮নং ওয়ার্ডের দিলদারের ওপর হামলা চালায়। সন্ত্রাসীরা দিদারের মাথায় রামদা দিয়ে একাধিক কোপ দেয়। এতে তার মাথায় ১৫টি সেলাই দিতে হয়েছে। ৮নং ওয়ার্ডে আকরামের দোকানে হামলা করেছে সন্ত্রাসীরা। হামলার পর সন্ত্রাসীরা দোকানের ক্যাশ থেকে নগদ টাকা, মোবাইল ফোন ও সিগারেট নিয়ে গেছে। ৮নং ওয়ার্ডের শিমুলের বাড়িতেও হামলার ঘটনা ঘটেছে। এতে বাধা দিলে শিমুলের মাকে মারধর করে সন্ত্রাসীরা। ৭নং ওয়ার্ডের স্বতন্ত্র কর্মী শাহেদকে না পেয়ে তার খামার থেকে মহিষ নিয়ে গেছে সন্ত্রাসীরা। জানা গেছে, স্থানীয় চেয়ারম্যানের নির্দেশে সন্ত্রাসীরা এসব হামলার ঘটনা ঘটিয়েছে।
চট্টগ্রামের হালিশহর এলাকার এক বাসিন্দা জানান, নির্বাচনের পর থেকে এখন পর্যন্ত এখানে সন্দ্বীপের কয়েকশ স্বতন্ত্র প্রার্থীর নেতাকর্মী আশ্রয় নিয়েছে। তারা ভয়ে বাড়ি ফিরতে পারছেন না।