কেমিক্যাল গোডাউনে আগুন, মারা গেলেন বাবা মা সন্তানসহ ৫ জন
কেরানীগঞ্জ প্রতিনিধি
প্রকাশ: ১৫ আগস্ট ২০২৩, ০৭:১০ পিএম
কেরানীগঞ্জে একটি কেমিক্যাল গোডাউনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। সেই আগুনে পুড়ে মারা গেছে গোডাউনসংলগ্ন বাসায় ঘুমিয়ে থাকা বাবা, মা, সন্তানসহ একই পরিবারের ৫ জন।
মৃতরা হলেন- গোডাউনের কেয়ারটেকার সোহাগ মিয়া (৩০), তার স্ত্রী মিনা (২২) ও তার শিশু সন্তান তাইয়েবা (২), ভাবি জেসমিন আক্তার (৩০) ও জেসমিনের মেয়ে ইশা (১৫)। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন সোহাগের মেয়ে তানহা, পিতা হানিফ ও মা পারুল। তাদের গুরুতর অবস্থায় রাজধানীর শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়েছে।
মঙ্গলবার রাত সাড়ে ৩টার দিকে কালিন্দী ইউনিয়নের গদারবাগ এলাকায় স্বাদ গ্লাস অ্যান্ড পলিমার নামে একটি প্রতিষ্ঠানের গোডাউনে আগুন লেগে হতাহতের ঘটনা ঘটে।
জানা গেছে, গোডাউনের মালিক হাজী আবুল হাসনাত টুটুল। তিনি আবাসিক এলাকায় জমি কিনে টিনশেড দিয়ে গোডাউন বানিয়েছেন। গোপনে সেই গোডাউনে কেমিক্যাল মজুদ করেছিলেন। গোডাউন দেখাশুনা করার জন্য সোহাগ মিয়াকে কেয়ারটেকার নিয়োগ দেন।
গোডাউনের পাশে কয়েকটি ঘর তুলে দিয়েছেন মালিক টুটুল। সেখানে স্ত্রী, দুই কন্যাকে নিয়ে সোহাগ মিয়া বসবাস করতেন। পাশাপাশি সোহাগের বড় ভাইয়ের স্ত্রী জেসমিন ও ভাতিজা ইশা এবং সোহাগের পিতা-মাতাও সেখানে থাকতেন। সোহাগের বড় ভাই মিলন সৌদি প্রবাসী।
স্থানীয় লোকজন জানান, পুরান ঢাকার চকবাজার এলাকায় প্লাস্টিক ও রাবারের জুতার ব্যবসা রয়েছে হাজী আবুল হাসনাত টুটুলের। জুতায় ব্যবহারের বিভিন্ন কেমিক্যাল ক্রয় করে কেরানীগঞ্জের গোডাউনে গোপনে মজুদ করে রাখতেন। রাতের আঁধারে এখান থেকে প্রয়োজনীয় কেমিক্যাল চকবাজারে নিয়ে যেতেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৯ সালে চকবাজারের ভয়াবহ কেমিক্যাল বিস্ফোরণে অর্ধশতাধিক মানুষ নিহত হওয়ার পর কেমিক্যাল গোডাউনগুলোতে সরকার নজরদারি বাড়িয়ে দেয় এবং পুরান ঢাকার আবাসিক এলাকা থেকে কেমিক্যাল গোডাউন সরিয়ে নেওয়ার তাগিদ দেওয়া হয়। এ সময় অনেককে জেল-জরিমানাও করা হয়। এ কারণে বিভিন্ন কেমিক্যাল ব্যবসায়ীরা পুরান ঢাকা থেকে গোডাউন গোপনে কেরানীগঞ্জের বিভিন্ন আবাসিক এলাকায় সরিয়ে নিয়ে আসে।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, কেরানীগঞ্জের কালিন্দী, গদারবাগ, নেকরোজবাগ, মালঞ্চসহ বিভিন্ন এলাকায় গোপনে শতাধিক কেমিক্যাল গোডাউন গড়ে তোলা হয়েছে। আবাসিক এলাকায় জমি কিনে চারদিকে বাউন্ডারি দেয়াল দিয়ে ভেতরে গড়ে তোলা হয়েছে এসব গোডাউন।
কেরানীগঞ্জ মডেল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) খালেদুর রহমান জানান, প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে। পরে তা ছড়িয়ে পড়ে কেয়ারটেকার সোহাগের ঘরসহ আশপাশের কয়েকটি ভবনে। এতে সোহাগ, তার স্ত্রী, সন্তানসহ পরিবারের ৫ জন মারা গেছেন। আহত হয়েছেন কয়েকজন। তবে নিহতের স্বজনরা বিনা ময়নাতদন্তে মরদেহ নেওয়ার আবেদন করেছেন। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত মোতাবেক মরদেহ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এ ঘটনায় মামলা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। গোডাউনের মালিক হাজী টুটুল গা-ঢাকা দিয়েছেন। তাকে গ্রেফতারে অভিযান চলছে।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স (হেড কোয়ার্টার) উপসহকারী পরিচালক সামসুজ্জামান মঙ্গলবার সকালে সাংবাদিকদের বলেন, আগুন নিয়ন্ত্রণে ৬টি ইউনিট কাজ করেছে। প্রায় ২ ঘণ্টা চেষ্টার পর আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। তবে কী কারণে আগুন লেগেছে তা তদন্ত না করে বলা যাবে না।
এদিকে অগ্নিকাণ্ডের খবর পেয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন ঢাকা-২ আসনের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম, ঢাকা জেলা প্রশাসক আনিসুর রহমান, কেরানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফয়সল বিন করিমসহ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। এ সময় কামরুল ইসলাম নিহত ও আহতদের পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।
পরিদর্শনের পর ঢাকা জেলা প্রশাসক আনিসুর রহমান বলেন, অবিলম্বে কেরানীগঞ্জের সব অবৈধ কেমিক্যাল গোডাউন বন্ধ করা হবে। এ ঘটনার বিস্তারিত জানতে এবং করণীয় নির্ণয়ে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসককে প্রধান করে ৫ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
কেরানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফয়সল বিন করিম জানান, নিহত ব্যক্তিকে ২৫ হাজার ও আহত ব্যক্তিকে ১৫ হাজার টাকা করে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে দেওয়া হবে। হতাহতদের পরিবারের মাঝে এখন পর্যন্ত ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা অনুদান দেওয়া হয়েছে।
নিহত সোহাগের বোন শারমিন আক্তার জানান, তাদের গ্রামের বাড়ি মুন্সীগঞ্জের লৌহজং থানার হলদিয়া গ্রামে। একটি দুর্ঘটনা তার পরিবারের ৫ সদস্যকে কেড়ে নিয়েছে। গুরুতর অবস্থায় বৃদ্ধ বাবা-মা ও ভাতিজি (নিহত সোহাগের মেয়ে) হাসপাতালে ভর্তি। কী বলব? বুকের ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে ভাই।