Logo
Logo
×

সারাদেশ

চট্টগ্রামে তিন দিনের বর্ষণে পানিবন্দি লাখ লাখ মানুষ

Icon

আহমেদ মুসা, চট্টগ্রাম

প্রকাশ: ০৬ আগস্ট ২০২৩, ১১:১৭ পিএম

চট্টগ্রামে তিন দিনের বর্ষণে পানিবন্দি লাখ লাখ মানুষ

সাইফুল ইসলাম আহাদ। চকবাজারের ডিসি রোডের বাসিন্দা। তিনি দীর্ঘ ছয় বছর ধরে ডিসি রোডে বসবাস করছেন। কালাম কলোনির একটি ভবনের দ্বিতীয়তলায় পরিবার নিয়ে থাকেন। পেশায় চাকরিজীবী। তিনি তিন দিন ধরে বাসায় পানিবন্দি।

সাইফুল ইসলাম আহাদ যুগান্তরকে বলেন, ছয় বছর ধরে এই এলাকায় বসবাস করছি কিন্তু এত পানি আর কখনো দেখিনি। শুক্রবার বিকাল থেকে জলাবদ্ধতা শুরু হয়। রাতে পানি কিছুটা কমেছিল। শনিবার সকালে আবার থৈ থৈ পানি আর পানি। রাত থেকে বিদ্যুৎ নেই। এ কারণে মোটরও চলছে না। জ্বলছে না চুলা। চারদিকে অথৈ পানি থাকলেও মিলছে না রান্না-বান্না কিংবা শৌচ-কর্ম করার মতো বিশুদ্ধ পানি। এ অবস্থায় চরম দুর্ভোগের মধ্য দিয়ে দিন কাটাতে হচ্ছে।

কেবল সাইফুল ইসলাম আহাদ নন, চকবাজার, কাপাসগোলা ও বাদুরতলাসহ নগরীর নিচু এলাকার লাখ লাখ মানুষ এভাবে পরিবার নিয়ে পানিবন্দি হয়ে গত তিন দিন ধরে এক প্রকার মানবেতর জীবনযাপন করছে।

বিভিন্ন এলাকার কোথাও হাঁটু পানি আবার কোথাও কোমর সমান পানি জমে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও বন্ধ রাখা হয়েছে।

রোববার সকালে নগরীর চকবাজার মুরাদপুরসহ কয়েকটি এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, পানি আর পানি। পাহাড়ি ঢল ও আর বৃষ্টির পানিতে পুরো নগরী যেন পরিণত হয় নদীতে।

পতেঙ্গা আবহাওয়া অধিদপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবহওয়াবিদ জহিরুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, রোববার বিকাল ৩টা পর্যন্ত পূর্ববর্তী ২৪ ঘণ্টায় ২৩১ দশমিক ৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। এছাড়া গত তিন দিনে যে বৃষ্টিপাত হয়েছে তা এ মৌসুমের সর্বোচ্চ রেকর্ড। সক্রিয় মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে এই ভারি বর্ষণ হচ্ছে। তা আরও দুই দিন অব্যাহত থাকতে পারে। চট্টগ্রামে ভারি বর্ষণের সঙ্গে যোগ হয়েছে কর্ণফুলীর জোয়ার ও পাহাড়ি ঢলের পানি।

চকবাজারের সৈয়দ শাহ রোডের বাসিন্দা গোলাম সারওয়ার যুগান্তরকে জানান, বাসার নিচে তিন দিন ধরে পানি জমে আছে। কোথাও বের হতে পারছি না। দুই ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছি। সকালে কোনো রকমে নাস্তা করেছি। দুপুরে কি করব জানি না। পানির কারণে বাইরে থেকেও খাবার আনা যাচ্ছে না।

নগরীর রাসূলবাগ আবাসিক এলাকার বাসিন্দা ফরিদুল আলম যুগান্তরকে বলেন, শনিবার শেষরাতের দিকে বৃষ্টি ও জোয়ারের পানি বাসায় উঠে গেছে। ঘর থেকে বের হওয়াই যাচ্ছে না। এর মধ্যে গাছের একটি খুঁটি ভেঙ্গে বিদ্যুতের তারের ওপর পড়েছে। পুরো এলাকা বিদ্যুৎবিহীন। যেন নরক যন্ত্রণায় আছি।

শ্রাবণের প্রবল বর্ষণে এবার সবচেয়ে বেশি জলাবদ্ধতা হয়েছে বহদ্দারহাট, বাদুরতলা, শুলকবহর, মোহাম্মদপুর, কাপাসগোলা, চকবাজার, বাকলিয়ার বিভিন্ন এলাকা, ফিরিঙ্গিবাজারের একাংশ, কাতালগঞ্জ, শান্তিবাগ আবাসিক এলাকা, কে বি আমান আলী রোড, চান্দগাঁওয়ের শমসের পাড়া, ফরিদার পাড়া, পাঠাইন্যাগোদা, মুন্সী পুকুরপাড়, আগ্রাবাদ সিডিএ আবাসিক এলাকাসহ বিভিন্ন আবাসিক এলাকায়। অপেক্ষাকৃত নিচু এলাকায় জমে থাকা পানির উচ্চতা অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় সড়ক দিয়ে মানুষ চলাচল করতে পোহাতে হচ্ছে সীমাহীন দুর্ভোগ।

এর মধ্যে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দেখা দিয়েছে জোয়ারের পানি। জোয়ারের ফলে আগ্রাবাদ, বন্দর, ইপিজেডের বিভিন্ন এলাকায় পানির উচ্চতা বেড়ে গেছে। যেখানে আগে হাঁটু পানি উঠতো সেখানে এখন কোমর সমান পানি। বাসা-বাড়ি, দোকানপাটেও পানি ঢুকে পড়েছে। দুই নম্বর গেট মুরাদপুর ও চকবাজার ব্যস্ততম সড়কের ওপর দিয়ে  প্রবাহিত হচ্ছে পানির স্রোত।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জলাবদ্ধতা নিরসনে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করা হলেও এর সুফল মিলছে না। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন- (চসিক) এ জন্য জলাবদ্ধতা প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে (চউক) দায়ী করলেও চউক দায়ী করছে চসিককে।

এই সংস্থার দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলছেন, নালা-নর্দমা ঠিকমতো পরিষ্কার না করার কারণে বৃষ্টির পানি নামতে পারছে না। এতে করে জলাবদ্ধতা ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। দুই সংস্থার পরস্পর দোষারোপের বলি হতে হচ্ছে নগরীর লাখ লাখ বাসিন্দাকে।

এবারের জলাবদ্ধতায় বাসা-বাড়ি, দোকান-পাট ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে পানি ঢুকে কোটি কোটি টাকার আসবাবপত্র, পণ্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নষ্ট হয়ে গেছে। স্বয়ং বহদ্দারহাটে মেয়রের বাসভবন তিন ধরে পানির নিচে রয়েছে। গাড়ি ছেড়ে তাকে রিকশা কিংবা পায়ে হেঁটে পানি মাড়িয়ে যাতায়াত করতে হচ্ছে কর্মস্থলে। 

চট্টগ্রাম ওয়াসা, পানি ভবন, নগরীর চান্দগাঁও থানার নিচতলা পানিতে তলিয়ে আছে। রোববারের জোয়ার-বৃষ্টি ও ঢলের পানিতে ডুবে ছিল কালুরঘাটে ফেরি চলাচলের জন্য স্থাপিত পন্টুন। দুই পাড়ের মানুষতে ফেরি পারাপারে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। বৃদ্ধ ও শিশু এবং রোগীদের কোলে করে পারাপার করতে দেখা যাচ্ছে। এ সময় রিকশা কিংবা গাড়ি থেকে পানি ছিটকে পড়ে দুর্ঘটনার মুখোমুখি হতে হচ্ছে যাত্রীদের।

বাণিজ্যিক এলাকা চাক্তাই-খাতুনগঞ্জে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে পানি ঢুকে ভিজে গেছে লাখ লাখ টাকার পণ্য। একই অবস্থা রিয়াজউদ্দিন বাজার এলাকায়ও। রিয়াজউদ্দিন বাজারের শত শত দোকানে পানি ঢুকেছে। টানা তিন দিন পানিতে ডুবে আছে রিয়াজউদ্দিন। দোকানে পানি ঢুকে পড়ার কারণে একদিকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কোটি কোটি টাকা অন্যদিকে ব্যবসা বাণিজ্যেও স্থবিরতা নেমে এসেছে।

ব্যবসায়ীরা জানান, রিয়াজউদ্দিন বাজারের গোলাম রসুল মার্কেট, আরএস রোড, বাহার লেইন, পশ্চিম বাজার, মশারি গলি, রহমতুন্নেচ্ছা রোড এবং জেবুন্নেচ্ছা রোডে হাঁটু পানি উঠে। এসব রোডে থাকা মার্কেট ও দোকানে পানি ঢুকে যায়। রিয়াজউদ্দিন বাজারের মোবাইল মার্কেটেও পানি ঢুকে যায়।

রিয়াজউদ্দিন বাজারে ব্যবসায়ী আবদুল হামিদ যুগান্তরকে বলেন, টানা তিন দিনের ভারি বর্ষণে রিয়াজউদ্দিন বাজারের শত শত দোকানে পানি ঢুকেছে। আগে যেসব দোকানে পানি ঢোকেনি সেসব দোকানেও এবার পানি ঢুকেছে। শুক্রবার বন্ধ থাকলেও শনিবার ও বোরবার কোনো ব্যবসা বাণিজ্যই হয়নি। কাপড়ের দোকানে পানি ঢুকে কোটি টাকার কাপড় নষ্ট হয়ে গেছে।

রিয়াজউদ্দিন বাজার এলাকার বাসিন্দা হুমায়ুন কবির জানান, এ বছর রিয়াজউদ্দিন বাজারে স্মরণকালের রেকর্ড ভঙ্গ করে পানি উঠেছে। রিয়াজউদ্দিন বাজারের প্রবেশপথে প্রায় কোমর সমান পানি হয়েছে। এখানে ড্রেন বড় করে কালভার্ট বানানো হয়েছে। তারপরও অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম