Logo
Logo
×

সারাদেশ

নারায়ণগঞ্জ সরকারি হাসপাতালে ধারাবাহিক অনিয়ম 

দালালের ইনজেকশন পুশে যুবকের মৃত্যু

Icon

রাজু আহমেদ, নারায়ণগঞ্জ

প্রকাশ: ০৪ আগস্ট ২০২৩, ০৭:২৯ এএম

দালালের ইনজেকশন পুশে যুবকের মৃত্যু

দালালের ইনজেকশন পুশে যুবকের মৃত্যু

নারায়ণগঞ্জে সরকারি হাসপাতালে এবার দালালের খপ্পরে পড়ে প্রাণ হারিয়েছেন হানিফ নামের এক যুবক। হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসকের দেওয়া প্রেসক্রিপশনে কোনো ইনজেকশনের নাম না থাকলেও ইয়ামিন শান্ত নামের এক চিহ্নিত দালালের দেওয়া ইনজেকশন পুশ করার কয়েক মিনিটের মধ্যেই মৃত্যু ঘটে ওই যুবকের। 

বৃহস্পতিবার (৩ আগস্ট) দুপুরে নারায়ণগঞ্জ জেনারেল ভিক্টোরিয়া হাসপাতালের সামনে ফার্মেসি পয়েন্ট নামক একটি ওষুধের দোকানে এই ঘটনা ঘটে। ঘটনার পর থেকে হাসপাতালের চিহ্নিত দালাল শান্তকে আর খুঁজে পওয়া যাচ্ছে না। 

নিহত হানিফ (২৫) ফতুল্লা থানাধীন পঞ্চবটি এলাকার কাশেম মাদবরের ভাড়াটিয়া আব্দুর রাজ্জাকের ছেলে। তিনি ফতুল্লায় একটি গার্মেন্টে কাজ করতেন। ঘটনার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই মৃত ওই যুবকের লাশ নিয়ে গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জ জেলার করিমগঞ্জে চলে গেছেন তার স্বজনরা। ঘটনার পর বিচার চাইলেও রহস্যজনক কারণে তারা বলছেন, ওই দালালের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ করবেন না। 

এদিকে মৃত হানিফের স্বজনদের হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দেওয়া মৃত্যুর প্রমাণপত্রে ‘ব্রট ডেথ’ বা মৃত অবস্থায় নিয়ে আসা হয়েছে বলে উল্লেখ করলেও এ নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। 

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, দালালের দেওয়া ইনজেকশন পুশ করার পর অসুস্থ অবস্থায় হানিফকে দ্বিতীয়বার হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে আসা হলেও তার অবস্থা অধিকতর খারাপ হওয়ায় চিকিৎসা দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন জরুরি বিভাগে কর্মরতরা। বরং তাকে দ্রুত ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। কিন্তু হাসপাতাল চত্বরেই হানিফ মারা যান।  

নিহতের স্বজন ও হাসাপাতাল সূত্রে জানা গেছে, পেটের ব্যথা নিয়ে বৃহস্পতিবার দুপুরে নারায়ণগঞ্জ সরকারি জেনারেল (ভিক্টোরিয়া) হাসপাতালে আসেন মৃত হানিফ ও তার সাথে থাকা বেশ কয়েকজন অজ্ঞাত বন্ধু। এ সময় হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক নাসরিন সুলতানা তাকে ব্যবস্থাপত্রে ইসোনিক্স ট্যাবলেট ( গ্যাস্ট্রিকের ) ও ভিসেট ট্যাবলেট (ব্যথা নাশক) নামক দুটি ওষুধ ও কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা লিখে দেন। 

ওই ব্যবস্থাপত্রে কোনো ইনজেকশন না থাকা সত্ত্বেও হাসপাতালে চিকিৎসকের কামরার সামনে অবস্থান নেওয়া শান্ত নামের দালাল তাদের সুলভে ওষুধ কিনে দেবার কথা বলে হাসপাতালের পাশে থাকা ‘ফার্মেসী পয়েন্টে’ নামের একটি ওষুধের দোকানে নিয়ে যায়। এ সময় রোগীর ব্যথা বেশি থাকায় ওই দালাল ব্যবস্থাপত্রের বাইরে একটি ইনজেকশন দেওয়ার জন্য বলেন এবং দালাল শান্ত নিজেই হানিফের শরীরে ওই ইনজেকশন পুশ করে। (ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজ হস্তগত হয়েছে)। এর পরই হানিফের শারীরিক অবস্থার আরও অবনতি ঘটা শুরু হয়। পরে চিকিৎসকদের বিষয়টি জানালে তারা হানিফকে দ্রুত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন। এরই মধ্যে হানিফের মৃত্যু হয়।

এ বিষয়ে হানিফের ভাই মো. লাদেন হোসেন জানান, আমার ভাইকে ভুল ইনজেকশন পুশ করে হত্যা করা হয়েছে। হাসপাতালে চিকিৎসকের কামরার সামনে কী করে দালালরা দাড়িয়ে থাকে? তবে হাসপাতাল চত্বরে নিজের ভাই হত্যার বিচার চাইলেও কয়েক ঘণ্টা পরই  মৃত হানিফের লাশ গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছেন বলে জানান লাদেন। 

তিনি বলেন, আমাদের কোনো অভিযোগ নেই। পাশাপাশি অসুস্থ হানিফের সাথে কে বা কোন বন্ধুরা ছিল তাও তিনি জানেন না বলে জানান।

এ ব্যাপারে এবং হাসপাতালে দালাল চক্রের দৌরাত্মের বিষয়ে জেলা সিভিল সার্জন ডা. মুশিউর রহমানের কাছে মোবাইলে জানতে চাইলে বেশ চটে যান। বেশ রুঢ় কণ্ঠে তিনি বলেন, এই ঘটনায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কোনোভাবেই দায়ী নয়। কারণ হানিফ নামের রোগীকে বহির্বিভাগের চিকিৎসক কোনো ইনজেকশনই ব্যবস্থাপত্রে লিখে দেননি। রোগীর স্বজনরা কে বা কার কথায় হাসপাতালের বাইরে গিয়ে ইনজেকশন দিয়েছেন এবং সে অসুস্থ হয়ে পরে। এমন বোকাকি তারা কীভাবে করল?

কিন্তু মৃত্যুর প্রমাণপত্রে কেন ‘ব্রট ডেথ’ লেখা হয়েছে- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি দাবি করেন, ইনজেকশন পুশের পর তাকে মৃত অবস্থাতেই জরুরি বিভাগে আনা হয়েছিল। মৃতের স্বজনরা মামলা করলে ময়নাতদন্ত হবে এবং তার পরই মৃত্যুর প্রকৃত কারণ বলা যাবে। 

তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে হাসপাতালের একটি সূত্র জানান, দালালদের দৌরাত্ম নিয়ে যাতে মিডিয়ায় কোনো সংবাদ না আসে সেজন্য তড়িঘড়ি করেই নিহত হানিফের মৃত্যুর প্রমাণপত্র দিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং আক্ষেপের বিষয় হলো- এই কাজে নেপথ্যে থেকে সেই দালাল চক্রই সাহায্য করেছে। অথচ বাইরে ইনজেকশন পুশের কারণেই তার মৃত্যু হয়েছে এবং ওই রোগীর স্বজনরা বেশ হৈচৈও করেছিলেন। কিন্তু দালালরা রোগীর স্বজনদের ভয় দেখিয়েছে যে, যেহেতু প্রেসক্রিপশনে ইনজেকশনের নাম লেখা ছিল না, তাই মামলা করলে স্বজনরাও ফেঁসে যেতে পারেন। 

উল্লেখ্য, গত  এক বছরে এই হাসপাতালটিতে দালালদের হাতে গণমাধ্যমকর্মীদের লাঞ্ছিত হওয়া থেকে শুরু করে নানা অঘটন নিয়ে দেশের প্রায় সব কটি শীর্ষস্থানীয় গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হলেও জেলা সিভিল সার্জন অফিসের পক্ষ থেকে আজ অবধি কোনো তদন্ত বা ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। অভিযোগ রয়েছে, শুধু সরকারি হাসপাতালের দালাল চক্রই নয়, পুরো জেলার অসংখ্য অবৈধ ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে প্রায়শই এমন অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে কোনো কোনো ক্লিনিক সিলগালা করে দিলেও কয়েক মাসের মধ্যে সেই ক্লিনিক আবারো খুলে ব্যবসায় নামেন মালিকরা।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম