
প্রিন্ট: ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:৪৫ এএম
পাহাড়ে মাছ চাষ
প্রকাশ: ১৯ জুলাই ২০২৩, ১২:৪৬ পিএম

বান্দরবানের পাহাড়ে মাছ চাষ করে সফলতা পাচ্ছেন নারীরা। ছবি: যোবায়ের আহসান জাবের
আরও পড়ুন
পাহাড়ে এবার মাছ চাষ করছেন নারীরা। পাহাড়ি ছড়ার পানি ও বৃষ্টির পানি আটকিয়ে তারা এসব মাছ চাষ শুরু করেছেন। মাছ চাষের এ ব্যবস্থা এখন পাহাড়ে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
একই সঙ্গে তারা নারী জেলে দলও গঠন করেছেন। নারীরা নিজেরা মাছ চাষ করছেন, আবার কারও পুকুরে মাছ ধরতে তারা ভাড়া হিসেবেও খেটে পরিবারের জন্য উপার্জন করছেন।
বান্দরবানের দুর্গম এলাকা রোয়াংছড়ি উপজেলার আলেক্ষ্যং ইউনিয়নের ওয়াগয় পাড়ায় গিয়ে দেখা যায় নারীরা দলবেঁধে মাছ ধরছেন।
তাদের এ উৎসাহ উদ্দীপনা দেখে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা।
বান্দরবানের রোয়াংছড়ি উপজেলার আলেক্ষ্যং ইউনিয়নের নারী জেলে দলের সভাপতি বিশাকাতো চঙ্কা যুগান্তরকে বলেন, এই এলাকার মানুষ আগে বান্দরবান শহর ও ঝিরি থেকে সংগ্রহ করতো। দেখা গেল, সারা দিন কষ্ট করেও অনেক সময় ঝিরি থেকে মাছ পাওয়া যেত না। আর বান্দরবান সদরে যাওয়া সবার পক্ষে সম্ভব ছিল না। অনেক টাকা খরচের কারণে গরিব মানুষদের বান্দরবান থেকে মাছ আনা ছিল স্বপ্নের বিষয়।
তিনি বলেন, এক কেজি মাছ আনতে বান্দরবান সদরে যেতে তখন ৫০০টাকা লাগত। এখন ১ হাজার টাকা দিয়েও যাওয়া যায় না। কিন্তু পকেটে যদি ৫০০ টাকাও না থাকে তাহলে কীভাবে যাব বান্দরবান? এজন্য এই এলাকার সবাই মাছ খেতে পারত না। কিন্তু এখন এই এলাকায় অনেক পুকুর আছে। অনেক মাছ পাওয়া যায়।
বান্দরবানের গ্রাউস (গ্রাম উন্নয়ন সংস্থা)-এর উপজেলা কো-অর্ডিনেটর তৃণা মারমা যুগান্তরকে বলেন, একটা সময় এই এলাকার মানুষ তাজা মাছ খেতে পারত না। এখান থেকে বান্দরবান শহরের বাজার থেকে মাছ কিনে আনতে হতো। দুর্গম এলাকা হওয়ায় এখান থেকে বান্দরবার সদরে (প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরত্ব) আসা-যাওয়ায় প্রায় ১ হাজার টাকা খরচ হয়ে যায়। কারণ, এখানে কোনো গণপরিবহণ নেই। গাড়ি রিজার্ভ করে যেতে হয়। সবমিলিয়ে গরিব মানুষগুলোর জন্য পাতে মাছ পাওয়া ছিল স্বপ্নের বিষয়। এখন আর সেই দিন নেই।
তিনি জানান, রোয়াংছড়ি উপজেলায় এখন আন্তর্জাতিক সংস্থা ইউএসএআইডির অর্থায়নে ও ওয়ার্ল্ডফিসের সহযোগিতায় বাংলাদেশ অ্যাকুয়াকালচার অ্যাক্টিভিটি আওতাধীন প্রকল্পে প্রায় আড়াইশ চাষী রয়েছেন। যারা উপযুক্ত ট্রেনিং নিয়ে নার্সারি বা মাছ চাষী হয়েছেন। এ কারণে এই এলাকায় মাছের উৎপাদন বেড়ে গেছে। অনেকেই পুকুর বা গোদায় মাছ চাষ করছেন। এতে অনেক পরিবারে স্বচ্ছলতা এসেছে। আগে রোয়াংছড়ি উপজেলায় ১০০টির মতো পুকুর ছিল। এখন এই উপজেলায় ৩০০টি পুকুর ও গোদা আছে। যেখানে নারীরা ট্রেনিং নিয়ে মাছ চাষ করছে। এতে যেমন পুকুর মালিকদের উপার্জন হচ্ছে সেই সঙ্গে এলাকাবাসীরও অনেক উপকার হয়েছে। এই এলাকার মানুষ তাজা তাজা মাছ খেতে পারছেন।
তিনি বলেন, মাদের নারী চাষীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে মাছ চাষের দিকে আগ্রহী করেছি। রোয়াংছড়ি উপজেলায় আগে পুকুর বা গোদায় ৫০-১০০ জনের মতো মানুষ মাছ চাষ করতেন। কিন্তু এই এলাকার নারীরা এখন আগ্রহী হয়ে ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে তারা পুকুর খনন করতে পারে, গোদা খনন করতে পারে। এমন প্রশিক্ষিত নারী ২৫০ জন রয়েছেন।
তৃণা মারমা যুগান্তরকে বলেন,বান্দরবানের নারীরা অনেক কিছু দিক দিয়ে পিছিয়ে আছে। এখানের সমাজব্যবস্থাটা পিতৃতান্ত্রিক, নারীদের হেয় করা হয়, অনেক কাজ করতে দেওয়া হয় না। আমাদের সঙ্গে ওই নারীদের দেখা হওয়ার পর জানিয়েছিল যে, তাদের একটা জালের দরকার। জালটা পেলে তারা বাড়তি আয় করতে পারবেন। ২০২১ সালে গ্রাউস ও ওয়ার্ল্ড ফিশ তাদের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে জাল দিয়ে সহায়তা করি। এই জালটা পাওয়ার পর থেকে তারা একটা বাড়তি আয় পাচ্ছে। তারা যদি কাউকে জাল ভাড়া দেয় তাহলে ৪০০টাকা করে নিচ্ছে। কিন্তু জালসহ নারী দল পুকুর থেকে মাছ ধরে দিলে প্রতিজনকে ৩০০টাকা করে পায়।
তিনি বলেন, এখন ওই নারীরা বেসরকারি একটি ব্যাংকে একটি অ্যাকাউন্ট খুলেছে। এতে তারা প্রতি মাসে নিজেদের সামর্থ অনুসারে জমা করছে। এটা নির্ধারিত কোনো অ্যামাউন্ট না, এটা ১০০ থেকে ১০০০ টাকা যখন যতটুকু সামর্থে কুলায় ততটুকু জমা করে। এভাবে জুন মাস পর্যন্ত তারা ৩০ হাজার টাকা জমিয়েছে।
কিছু কিছু অঞ্চলে তৈরি হয়েছে পর্যটনের সম্ভাবনা। পাহাড়ি পরিবেশে মাছ চাষের মাধ্যমে আমিষের অভাব পূরণ হওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হচ্ছে। দরিদ্র পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়নে আধুনিক মৎস্য চাষ প্রযুক্তি জ্ঞানের অভাব এবং পুঁজির সংকটের কারণে অধিকাংশ দরিদ্র পাহাড়ি জনগোষ্ঠী তা সদ্ব্যবহার করতে পারছিল না এ ছাড়াও গুণগত মানসম্পন্ন পোনার অভাব এবং স্থানীয় পর্যায়ে সময়মত পোনা সরবরাহ না থাকায় মাছ চাষ কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছিল।
ওয়ার্ল্ডফিসের অ্কুয়ার কালচার স্পেশালিস্ট এসএম জাফরুল্লাহ শামসুল যুগান্তরকে বলেন, পাহাড়ের মাছের স্বাদটা বেশি। এটা প্রাকৃতিক উপায়ে চাষের কারণেও হতে পারে। এখানকার চাষ করা তেলাপিয়ার চাহিদা চট্টগ্রামে সবচেয়ে বেশি। এই মাছ বান্দরবানে যতটা চাহিদা তার চেয়েও বেশি চাহিদা চট্টগ্রামে।
তিনি জানান, এই চাষীরা যাতে গুণগত পোনা পেতে পারে সেজন্য এই এলাকায় নার্সারিও তৈরি হয়েছে।
২০১৮ সালে আইএমইডির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, হেক্টর প্রতি মাছের উৎপাদন হচ্ছে ৭১৫ কেজি। এখন এই সংখ্যা কয়েকগুণ বেড়েছে। কারণ ৫ বছর আগে এই পাহাড়ি এলাকায় মাত্র ১২৮টি পুকুর বা গোদা ছিল, এখন এই সংখ্যা প্রায় ৩ শতাধিক। যা এলাকার জনগণের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নে এবং পুষ্টির মান উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে।
ওয়ার্ল্ডফিসের সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার মো. এমদাদ হোসেন যুগান্তরকে বলেন, বান্দরবান এলাকায় মাছ চাষের তেমন প্রচলন ছিল না। মাছ চাষ কীভাবে করতে হয় তা ওই অঞ্চলের মানুষের জানা ছিল না। এই এলাকার মানুষের প্রোটিনের চাহিদা পূরণে ওয়ার্ল্ডফিসই প্রথমে কাজ শুরু করে। এখন তারা সচেতন হয়েছে। তারা উপযুক্ত প্রশিক্ষণ নিয়ে তারা মাছ চাষ করছেন। এতে মাছের জন্য অন্য এলাকার ওপর নির্ভরতা তাদের কমে আসছে। একই সঙ্গে প্রয়োজনের অতিরিক্ত মাছ তারা বিক্রি করে সংসারের উন্নতিতে কাজে লাগাচ্ছেন।
পাহাড়ের মাঝে গোদা হয় কীভাবে?
পাহাড়ের মাঝে পুকুর ও গোদা আসলো কীভাবে? এ কৌতূহল অনেকের মাঝেই রয়েছে।
এ বিষয়ে অ্যাকুয়ার কালচার স্পেশালিস্ট এসএম জাফরুল্লাহ শামসুল যুগান্তরকে বলেন, গোদাটা হচ্ছে, পাহাড় থেকে ঘেমে ঘেমে যে পানি একপাশে জমা হয়, সেটা যদি আটকানো হয় তাহলে সেটা মাছ চাষের উপযোগী হয়। এখানের সুবিধাটা হচ্ছে এখানে পানি কখনও শুকায় না। সারা বছর মাছ চাষ করা যায়।