‘পাক-হানাদারদের ভয়ে মায়ের হাত ধরে সেকি প্রাণান্তকর ছুটে চলা’
নিয়ামতপুর (নওগাঁ) প্রতিনিধি
প্রকাশ: ১৪ মে ২০২৩, ১১:০৩ পিএম
পাক-হানাদার বাহিনীর ভয়ে মায়ের এক হাত ধরে ছুটে চলার পর দিনভর খাঁড়ির জঙ্গলে লুকিয়ে থাকার কথা কখনই ভুলব না। ভুলব না মায়ের সেই মলিন মুখ ও আমাদের আগলে রাখার কথা। খাঁড়ির পানি আঁচল দিয়ে ছেঁকে আমাদের পিপাসা নিবারণ করার কথা। মায়ের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে কথাগুলো বলেন উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ফরিদ আহম্মেদ। ‘বিশ্ব মা’ দিবসের স্মৃতিচারণ করতে তিনি মায়ের সঙ্গে কাটানো বিভীষিকাময় একটি দিনের কথা বলেন যুগান্তরকে।
ফরিদ আহম্মেদ বলেন, দিনটি ছিল ১৯৭১ সালের মে মাসের কোনো এক সোমবার। পাক-বাহিনীর বিরুদ্ধে স্বাধীনতা যুদ্ধ চলছে দেশের সর্বত্রই। খবর আসছে পাক-বাহিনী নির্বিচারে বৃদ্ধ, শিশু ও নর-নারীদের হত্যা করছে। আমার বয়স তখন ৭/৮ বছর হবে হয়তো। হঠাৎ করেই সকালে খবর এলো পাক-হানাদার বাহিনী প্রবেশ করেছে নিয়ামতপুরে। মা তখন রান্নার কাজে ব্যস্ত ছিলেন। আর আমি ছোট বোন রোকেয়াকে নিয়ে বাড়ির বারান্দায় খেলা করছিলাম। পাক-বাহিনীর খবরে মা হাতের সব কাজ ফেলে ছোট বোন রোকেয়াকে কোলে নিয়ে ও আমার এক হাত ধরে দ্রুত দৌড়ে বের হলেন বাড়ি থেকে। আর বাবা সঙ্গে নিলেন অন্য ভাই-বোনদের। কি কারণে এভাবে বাড়ি থেকে বের হওয়া তখনো বুঝতে পারিনি। মা ক্লান্ত শরীর নিয়ে ছুটেই চলছেন মাঠের পর মাঠ। মাঝে মধ্যে আমি রাস্তায় হোঁচট খেয়ে পড়ে যাচ্ছি। মা আমাকে সযত্নে তুলে দিচ্ছেন। হাঁটুর ধুলা মুছে দিয়ে একটু আদর করে আবার ছুটে চলছেন। প্রায় আধা ঘণ্টা এভাবে দৌড়ানোর পর আমরা পৌঁছলাম একটি খাঁড়ির পাড়ে।
তিনি আরও বলেন, মা আমাদের নিয়ে সেই খাঁড়ির জঙ্গলে ঢুকে পড়লেন। তখন আমি পিপাসায় কাতর, পানির কষ্টে ছটফট করছি। বোনটিও কান্নাকাটি করছে। আমাদের এমন দশা দেখে মা খুব সাবধানে একটি পাতিলে খাঁড়ির পানি সংগ্রহ করে তা আঁচল দিয়ে ছেঁকে আমাদের খাওয়ালেন। খাঁড়ির পানির সেই স্বাদ যেন আজও অম্লান। লক্ষ্য করলাম, মায়ের চোখে-মুখে কেমন যেন আতঙ্কের ছাপ। তারপরও আমাদের নিরাপদ রাখতে মায়ের সে কি প্রাণান্তকর চেষ্টা; যা কখনই ভুলবার নয়। মা সারা দিন রৌদ্রের মধ্যে খাঁড়ির জঙ্গলে সযত্নে আমাদের নিয়ে কাটালেন। পরে সংবাদ এলো পাক-বাহিনী চলে গেছে এলাকা ছেড়ে। তবুও যেন সন্তানদের প্রাণরক্ষায় ভয় কাটে না মায়ের মনে। এরপরও ভয়ে ভয়ে মা আমাদের নিয়ে উঠলেন পার্শ্ববর্তী ধরমপুর গ্রামের এক আত্মীয় মরহুম আব্দুস সামাদের বাড়িতে। সেখানে খাওয়া দাওয়া করে রাতে ফিরে এলাম নিজ বাড়িতে। পরে ১৬ ডিসেম্বর বিজয় হলো। শত্রুমুক্ত হলো দেশ। বিজয় মিছিল হলো। স্বাধীনতাকামী আমার “মা” মরহুম মাজেদা স্বাধীন বাংলাদেশের গর্বিত নাগরিক হয়ে পরপারে পাড়ি জমান। আজ বিশ্ব মা দিবসে খুব মনে পড়ে মা তোমাকে। দোয়া করি ভালো থেকো তুমি ওপারে।