হাওড়ে ধানে চিটা, ধারদেনায় নাজুক কৃষক
কুলাউড়া (মৌলভীবাজার) প্রতিনিধি
প্রকাশ: ২৮ এপ্রিল ২০২৩, ০৮:৫৮ পিএম
ছবি: যুগান্তর
‘বিভিন্নজনের কাছ থেকে ধারদেনা করে প্রায় ৬ বিঘা জমিতে বোরো ধান চাষ করছিলাম। আশা ছিল, ধান তুলে কিছুটা বিক্রি করে ঋণ পরিশোধ করবো এবং সারা বছর নিজে খাবো। কিন্তু কপাল এতই খারাপ যে, ৬ বিঘার মধ্যে ৪ বিঘার ধান মরে গেছে। এখন চিন্তা করছি- কীভাবে ঋণ পরিশোধ করবো এবং সারা বছর কেমনে ভাত খেয়ে বাঁচবো।’
কথাগুলো বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন কুলাউড়া উপজেলার জয়চন্ডী ইউনিয়নের উত্তর রংগীরকুল গ্রামের কৃষক শাহিন আহমদ। এমন কান্না শুধু শাহিন আহমদের নয়, উপজেলার হাকালুকি হাওড়সহ বোরো নির্ভরশীল এলাকার হাজারো কৃষকের।
উপজেলা কৃষি সূত্র জানায়, এ বছর বোরো চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৮ হাজার ৩১৮ হেক্টর। চাষাবাদ হয়েছে ৮ হাজার ৪৯০ হেক্টর। প্রায় ১৭২ হেক্টর বেশি চাষাবাদ হয়েছে। ব্লাস্ট রোগে আক্রান্ত হয়ে নষ্ট হয়েছে প্রায় ১৫ হেক্টর জমি। আর কৃষকরা বলছেন, হাওড়গুলোতে আবাদ করা পুরো ব্রি-২৮ জাতের ধানে ব্লাস্ট রোগে আক্রান্ত হয়েছে। এছাড়া ব্রি-২৯ ও ৯২ জাতের ধান ৫০-৭০ ভাগ পর্যন্ত নষ্ট হয়েছে। যার পরিমাণ সরকারি তথ্যের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি।
কুলাউড়া উপজেলা এবং হাকালুকি হাওড়ের দক্ষিণ তীরের কয়েক হাজার হেক্টর জমি ধান কাটছেন না কৃষকরা। তাদের মতে, এক বিঘা জমির ধান কাটতে দিতে হয় আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা। ধান পাওয়া যাবে না ৩ মন। তাই টাকা খরচ করতে রাজি নয় কৃষকরা। মরে পচে জমিতেই নষ্ট হচ্ছে কৃষকের কষ্টের ফসল। ক্ষোভে কৃষকরা বলেন, সরকারি কর্মকর্তারা অফিসে বসে হিসাব করেন। উৎপাদন দ্বিগুণ তিনগুণের স্বপ্ন দেখছেন। হাওড়ে আসলে বাস্তব চিত্র দেখতেন। জানতেন, কি পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে।
জানা গেছে, কুলাউড়া উপজেলার ভূকশিমইল, জয়চন্ডী, বরমচাল, ভাটেরা ও কাদিপুর ইউনিয়নের প্রায় ৮০-৯০ ভাগ কৃষকের একমাত্র সম্বল হাওড়ে উৎপাদিত বোরো ফসল। তাদের পুরো বছরের খোরাকি এবং ধার দেনাসহ সব ব্যয় চলে ওই ধান বিক্রির টাকা দিয়ে।
এ বছর বোরো মৌসুমে দীর্ঘ মেয়াদী খরা, স্থানীয় কৃষি কর্মকর্তাদের তদারকির অভাব ও পানি সেচের সুবিধা না থাকায় হাওড়ে কৃষকের রোপন করা ব্রি-২৮, ২৯ ও ৯২ জাতের ধানে ব্লাস্ট রোগে আক্রান্ত হয়েছে। এতে চরম লোকসানে পড়েছেন হাওড় পাড়ের কয়েক হাজার প্রান্তিক কৃষক ও বর্গাচাষি। কোথাও পুরো জমির ধানে চিটা ধরায় অনেক কৃষক ধান কাটতে অনীহা প্রকাশ করছেন।
জয়চন্ডী ইউনিয়নের জকিরবিল হাওড়ে ব্রি-২৮, ২৯ ও ৯২ জাতের বোরো আবাদ করেছিলেন কৃষক শাহিন আহমদ, বাদই মিয়া, এলাইছ মিয়া, মুজিব মিয়া, ফারুক আহমদ, হারিছ আলীসহ আরও অনেকে। তারা বলেন, এ হাওড়ে ব্রি-১৪ নং গাজী জাতের ধান খুব ভালো ফলন হয়। কিন্তু বীজ বপনের সময় উপজেলা সরকারি গুদামে গিয়ে ব্রি-১৪ পাননি তারা। তখন কৃষি বিভাগের লোকজন বলেছেন, ব্রি-২৮, ২৯ ও ৯২ জাতের ধান আবাদ করতে, এগুলোরও ফলন ভালো হয়। আর ধানগুলো রোপণ করেই তাদের আজ এ অবস্থা। কী কারণে ধান মরে গেলো তাও বলতে পারছেন না তারা।
কৃষকরা বলছেন, মৌসুমের শুরু থেকে কৃষি বিভাগের মাঠ পর্যায়ের কর্মীরা তৎপর হলে এমনটি হতো না। তাদের অভিযোগ, কৃষি বিভাগের মাঠ পর্যায়ের কর্মীদের তারা পান না। এমনকি ফোন করলেও দেখা করেন না বা কোনো পরামর্শ দেন না।
ভুকশিমইল ইউনিয়নের ২নং ওয়ার্ডের ইউপি সাহেদ আহমদ বলেন, ৮০ শতাংশ ব্রি-২৮ ও ২৯ জাতের ধানে ব্লাস্ট রোগে আক্রান্ত হয়েছে। এসব ধান কাটতে চাচ্ছেন না কৃষকরা। আমিও কিছু ধান কেটে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। ওই এলাকার কৃষক রিয়াজুর রহমান বলেন, অতিরিক্ত ওষুধ এবং স্থানীয় কৃষি কর্মকর্তাদের উদাসিনতায় এমনটি হয়েছে। স্থানীয় কৃষি কর্মকর্তারা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করলে এতো বড় বিপর্যয় হতো না।
বাদে ভুকশিমইল গ্রামের আরিফুর রহমান বলেন, ইউনিয়ন পর্যায়ে একজন কৃষি উপসহকারী আছেন, এটা আমিসহ অনেকই জানেন না। একই অভিযোগ সাতির আলী, নিমার আলী, বদরুল ইসলাম খান, মাখন মিয়া, রফিক মিয়া, সাহাব উদ্দিন, নাজিম উদ্দিন, মহিবুল ইসলামসহ শত শত কৃষকের।
কৃষকরা বলছেন, সরকারি সহায়তা না পেলে আগামীতে তাদের পক্ষে আর চাষবাদ করা সম্ভব হবে না। একই সঙ্গে ক্ষুদ্র, প্রান্তিক ও বর্গাচাষিদের আর্থিক সহায়তা না করলে ঋণ পরিশোধ করাসহ পরিবার-পরিজন নিয়ে তাদের না খেয়ে থাকতে হবে।
মৌলভীবাজার জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক শামছুদ্দিন আহমেদ বলেন, প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, আবহাওয়ার কারণে ধান ব্লাস্ট রোগে আক্রান্ত হয়েছে। রাতে ঠান্ডা-দিনে গরম এই পরিস্থিতে ব্রি-২৮ জাতের ধানের জন্য খুবই ক্ষতিকর। কৃষি বিভাগ সব সময় কৃষকদের পাশে আছে। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের তালিকা তৈরি করা হবে।
জনবল সংকটের কথা জানান জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের এ উপপরিচালক। তিনি বলেন, প্রত্যেক ইউনিয়নে একজন দ্বায়িত্বপ্রাপ্ত উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা থাকেন। কিন্তু একজনকে দিয়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে সচেতনতা তৈরি করা সম্ভব হয় না। তবুও আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি।