Logo
Logo
×

শেষ পাতা

বেইলি রোডের অগ্নিকাণ্ড

৪৬ জনের প্রাণকাড়া ভবনে আজও আতঙ্ক

Icon

যুগান্তর প্রতিবেদন

প্রকাশ: ০১ মার্চ ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

৪৬ জনের প্রাণকাড়া ভবনে আজও আতঙ্ক

ফাইল ছবি

রাজধানীর বেইলি রোডে বহুতল ভবন গ্রিনকোজি কটেজের সর্বত্র এক বছর আগের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের স্মৃতি এখনো তাজা। এখনো ভবনের কোনো কোনো স্থানে চোখ পড়লেই আঁতকে ওঠেন সাধারণ মানুষ। যেন ৪৬টি তরতাজা প্রাণ আগুন থেকে বাঁচতে বাঁচাও, বাঁচাও... চিৎকার করছে। বিধ্বংসী ভবনটি দেখলেই শিশু এবং প্রিয়জন হারা স্বজনরা এখনো কেঁদে ওঠেন। ভবনটির নির্মাণ ও ব্যবহারকারীদের চরম অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে সংঘটিত সেই অগ্নিকাণ্ড কেড়ে নিয়েছে ৪৬ জনের প্রাণ। শতাধিক লোক আহত হয়েছেন, অনেকেই দগ্ধ শরীর নিয়ে এখনো বেঁচে আছেন। অন্যদিকে এখনো ভবনটি মানুষ খেকোর চিহ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আশপাশ ভবনের গায়ে পড়েছে নতুন রঙের প্রলেপ। আর প্রাণখেকো ভবনটি যেন দিনে দিনে আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে। ভেতর-বাইরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে পোড়া বস্তু, তারের জট।

গত বছরের ২৯ ফেব্রুয়ারি রাত ৯টা ৫০ মিনিটের দিকে গ্রিনকোজি কটেজ ভবনে আগুন লাগে। প্রায় দুই ঘণ্টায় ১৩টি ইউনিটের চেষ্টায় সেই ভয়াবহ আগুন নিয়ন্ত্রণে এলেও-ততক্ষণে নিভে যায় ৪৬ জনের প্রাণ প্রদীপ। নিহতদের মধ্যে ২০ জন পুরুষ, ১৮ জন নারী ও আটটি শিশু ছিল। আহত হন শতাধিক মানুষ। এত হতাহতের ঘটনায় ন্যায়বিচার, ক্ষতিপূরণের প্রতিশ্রুতিসহ তদন্ত কমিটি গঠনের কমতি ছিল না। কিন্তু, প্রিয়জন হারা স্বজন এবং সচেতন মহলের ভাষ্য, সব প্রতিশ্রুতিই ভাঁওতায় পরিণত হচ্ছে। মামলায় অভিযুক্তদের মধ্যে আটজনকে গ্রেফতার করা হলেও সবাই এখন জামিনে মুক্ত।

মাইসা কবীর ও মেহেরা কবীর দুই বোন। একজন ব্যাংকার অন্যজন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ছিলেন। যে রাতে গ্রিনকোজি কটেজে আগুন লাগে, সেসময় ওই ভবনের একটি রেস্টুরেন্টে বসে দুবোন খাবার খাচ্ছিলেন। সেই আগুনে ওই দুবোনও প্রাণ হারান। বৃহস্পতিবার তাদের বাবা কবির খান যুগান্তরকে বলেন, ‘মেয়েদের নিয়ে তিনি মতিঝিল এলাকায় থাকতেন। ব্যাংকার মেয়ের সদ্য বিয়ে হয়েছিল আর আরেক মেয়ে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছিল। ভবনসংশ্লিষ্ট অসাধু দানবদের কারণেই দুই মেয়ের মৃত্যু হয়েছে। কী বলব, কার কাছে বলব। কে বিচার করবে। আর কিছুই বলতে চাই না।’

বুধবার দুপুরে দগ্ধ ভবনের সামনে দাঁড়িয়ে কাঁদছিলেন তামান্না ইসলাম তনু নামের এক শিক্ষার্থী। জানালেন, তিনি ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের দ্বিতীয়বর্ষের ছাত্রী। এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-শিক্ষকের মেয়েসহ ৫ জন বেইলি রোডের অগ্নিকাণ্ডে মারা গেছেন। ভবনটির রেস্টুরেন্টে বিভিন্ন স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীরা নিয়মিত খেতে যেতেন। কে জানত, রেস্টুরেন্টগুলোই তাদের প্রাণ কেড়ে নেবে। ওই ভবনের সামনে গিয়ে অনেকেই এখনো কেঁদে ওঠেন। এখনো বেইলি রোড ঘিরে শত শত রেস্টুরেন্ট-খাবারের দোকান রয়েছে। কেউ কি নিশ্চিত করে বলতে পারবে, ওই সব খাবারের দোকানের যথাযথ ব্যবস্থাপনা আছে কিনা? আবার যে আগুন লাগবে না, মানুষ মারা যাবে না-এর গ্যারান্টি কি সরকার দেবে?

ইতালি প্রবাসী সৈয়দ মোবারক হোসেন দেশে এসেছিলেন স্ত্রীসহ তিন সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে ইতালি যেতে। তাদের পাসপোর্ট, ভিসা সবই হয়েছিল। ভ্রমণের কয়েক দিন আগে অর্থাৎ ২৯ ফেব্রুয়ারি তিনি পরিবার নিয়ে বেইলি রোডে খেতে গিয়েছিলেন। সেই রাতের বিধ্বংসী আগুন তার স্ত্রী স্বপ্না আক্তার, মেয়ে তাশফি, ছেলে নূর ও আব্দুল্লাহকে কেড়ে নিয়েছে। তার ছোট ভাই সৈয়দ আল আমীনের ভাষ্য, মানুষ মারার ফাঁদ তৈরি করে রাখা হয়েছে রাজধানীর রেস্তোরাঁগুলোতে। কি অপরাধ ছিল, কেন তাদের মরতে হলো। সরকার কী জবাব দেবে। সরকারের সংস্থাগুলোর চরম ব্যর্থতার জন্যই তো এমন মৃত্যু। সরকার কি এ দায় নিয়েছে, ক্ষতিপূরণ দিয়েছে, দেবে?’ স্বজন হারা স্বজনদের মধ্যে এরকম শত প্রশ্ন ঘুরে বেড়াচ্ছে। স্বজন হারা পরিবারের অন্তত ১২ জনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কারও সন্তান, কারও বাবা, কারও স্ত্রী, কারও মা বেঁচে থাকার জন্য স্বজনদের কাছে ফোন করেছিলেন। ফোন শেষ হতে না হতেই অনেকেই মৃত্যুরকোলে ঢলে পড়েন।

বৃহস্পতি ও শুক্রবার দগ্ধ ভবনের আশপাশ ঘুরে দেখা যায়, পথচারীদের অনেকেই আগুনে পোড়া ভবনটি দেখছেন। অনেককে হা-হুতাশ করতেও দেখা গেছে। শান্তিনগর এলাকায় বসবাসকারী লুৎফুন নাহার ফুল জানান, তার দুই মেয়েও প্রায়ই ওই ভবনে খেতে যেতেন। ভবনের পাশ দিয়ে যেতেই, বুকটা ধড়ফড় করে ওঠে।

রিকশা থামিয়ে ভবনটির ছবি তুলছিলেন মানিক মিয়া নামের এক ব্যক্তি। তিনি বললেন, ভবনটি দাঁড়িয়ে আছে। যাদের জন্য এতগুলো মানুষ মারা গেল, তাদের কী বিচার করা হয়েছে? এ দেশে বিচার নেই। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোতে কেউ কি গিয়েছে? অনেকের পরিবার নিঃস্ব হয়ে গেছে। একটি টাকা কি ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে?

ভস্মীভূত ভবনটি ভয়ঙ্কর চেহারা নিয়ে এখনো ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। সম্প্রতি ভবনটির সামনের অংশে টিন দিয়ে বেড়া দেওয়া হয়েছে। ফুটপাত বন্ধ রাখা হয়েছে। স্থানীয়দের অভিযোগ, রক্তের দাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এ ভবনই সাক্ষী-দোষীদের বিচার দ্রুত সম্পন্ন হোক। শুধু দগ্ধ ভবনটি নয়, বেইলি রোডের বাণিজ্যিক ভবনগুলোর মধ্যে অধিকাংশেই অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা নামেমাত্র। রেস্তোরাঁসহ বাণিজ্যিক ভবনগুলোতে নিরাপত্তা যেমন হওয়ার প্রয়োজন, তার তো প্রায় কিছুই নেই। একাধিক শ্রমিকের ভাষ্য, অগ্নিকাণ্ডের পরে আগুন নেভাতে এখানকার শ্রমিক-কর্মীদের প্রাথমিক প্রশিক্ষণটুকুর ন্যূনতম ব্যবস্থাও নেই। সবই চলছে সেই পুরোনো নিয়মে।

অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় সর্বশেষ আইনি প্রক্রিয়া বিষয়ে জানতে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগে (সিআইডি) গিয়ে জানা যায়, অগ্নিকাণ্ডে মৃত্যুর ঘটনায় ভবনের মালিক, ব্যবসায়ীসহ শ্রমিকদের মধ্যে আটজনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। গ্রেফতারদের সবাই জামিনে থাকায় ক্ষতিগ্রস্তরা মনে করছেন, মামলার অগ্রগতি এবং আসামিরা খুব সহজেই খালাস পেয়ে যাবেন। মামলার সর্বশেষ অবস্থা নিয়ে যুগান্তরের সঙ্গে কথা বলেন, সিআইডির তদন্তকারী কর্মকর্তা ইনস্পেকটর মো. শাহ জামান মুন্সী। তিনি বলেন, ‘এ মামলায় গ্রেফতার আটজন জামিনে রয়েছেন। আমাদের তদন্ত ব্যাহত হচ্ছে না। সর্বশেষ রাজউক ও আমিন মোহাম্মদ ফাউন্ডেশনকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। ভবনটির বিষয়ে বিস্তারিত তথ্যাদি এবং চাহিদা অনুযায়ী তথ্য-উপাত্ত দেওয়ার জন্য প্রায় ১ মাস আগে চিঠি দেওয়া হয়। সিআইডি চায়, এর যথাযথ তদন্ত এবং তদন্ত শেষে প্রকৃত দোষীদের বিচার। কেউই দোষ আড়াল করতে পারবে না। তদন্তে সবই বেরিয়ে আসছে।’

নিহত পরিবারের কেউ ক্ষতিপূরণ পাননি : নিহত ৪৬ জনের কোনো স্বজন ক্ষতিপূরণ পাননি। অথচ বিনা অপরাধে এসব মানুষ আগুনে পুড়ে মারা গেছেন। ভোক্তভোগীদের ভাষ্য, এতবড় একটি ভবনে সিঁড়ি ছিল সরু, সিঁড়ির আশপাশ ভরা ছিল গ্যাসের সিলিন্ডারসহ বিভিন্ন ক্ষতিকারণ দ্রব্য-মালামাল। অর্থাৎ মানুষ মারার একটি ফাঁদ ছিল ওই ভবন। গত বছরের ৩ মার্চ সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার মো. সোলায়মান তুষার আগুনে ৪৬ জনের মৃত্যুর ঘটনা তদন্ত করতে বিচার বিভাগীয় কমিশন গঠন এবং ক্ষতিগ্রস্তদের প্রত্যেককে পাঁচ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণের দাবিতে আইনি নোটিশ পাঠান, যা আজও বাস্তবায়ন হয়নি।

গাফিলতি খুঁজে পায়নি রাজউক : অগ্নিকাণ্ডের পরপরই রাউজক সাফ জানিয়ে দিয়েছিল, ভবনে রেস্তোরাঁ বা পণ্য বিক্রয়কেন্দ্রের কোনো অনুমোদনই ছিল না। তাদেরই তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে আসে, অগ্নিকাণ্ড ও ৪৬ জনের মৃত্যের ঘটনায় দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ও ফায়ার সার্ভিসের গাফিলতি ছিল। গত বছরের ২৭ মার্চ জমা দেওয়া প্রতিবেদনে নিজেদের দোষ আড়ালেই রেখেছে। কিন্তু পুলিশের করা মামলার এজাহারে বলা হয়-রাজউকের দোকান-পরিদর্শকদের ‘ম্যানেজ’ করে ভবনে রেস্তোরাঁ ব্যবসা চলছিল। বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, ভবনের ব্যবহার সনদ আছে নাকি নেই, তা দেখার পুরো দায়িত্ব রাজউকের।

সিলিন্ডারসহ অন্যান্য জিনিসপত্রে ভরা ছিল ভবন : মূলত ভবনে লিকেজ থেকে সৃষ্ট গ্যাস জমে থাকার কারণেই আগুন এত দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। ফায়ার সার্ভিসের পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট ওই তদন্ত কমিটির নেতৃত্ব দেন ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী। প্রতিবেদন অনুযায়ী, হোটেলে যেখানে বসে মানুষ খাওয়া দাওয়া করত, সেখানেও রাখা ছিল সিলিন্ডার। ভবনের একটিমাত্র সিঁড়ি, সেটাও স্টোররুম বানিয়ে রাখা হয়েছিল। সিলিন্ডারসহ অন্যান্য জিনিসপত্রে ভর্তি ছিল ভবনটি।

শুধু শোক নয়, ক্রোধ জ্বলছে স্বজনদের বুকে : স্বজনদের অনেকে বলেছেন, রেস্তোরাঁ কিংবা বাণিজ্যিক ভবন-এসবে জননিরাপত্তা নিশ্চিত করা সরকার এবং সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর। সংশ্লিষ্টদের ব্যর্থতায় সাধারণ মানুষ মরছে। বিচার নেই, ক্ষতিপূরণ নেই। আবার যৎসামান্য ক্ষতিপূরণ কিংবা সান্ত্বনা পেলেও কি প্রাণ ফিরে পাওয়া যায়? সরকার, রাজউক, ফায়ার সার্ভিস ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর (এমন অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট) অযোগ্যতাকেই কাঠগড়ায় তুলেছেন স্বজনরা। প্রিয়জন হারানোর যন্ত্রণার সঙ্গে ‘তদন্ত কমিটি’, ‘প্রতিবেদন’, ‘ক্ষতিপূরণের’ কোনো অঙ্কই যে মেলে না।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম