সারা দেশে ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের প্রতিবাদে শেকল ভাঙার পদযাত্রা পালন করছেন নারীরা। শুক্রবার রাতে শাহবাগ থেকে শুরু হয়ে নারীদের এই পদযাত্রা সিটি কলেজ, কলাবাগান, মানিক মিয়া এভিনিউ হয়ে সংসদ ভবনে শেষ হয়।
এতে বলা হয়, নারী পুরুষের সমান অধিকার এ দেশে কেবল বইয়ের পাতাতেই সীমাবদ্ধ। আজও রাষ্ট্র প্রতিমুহূর্তে ব্যর্থ হয় একজন নারীর সুরক্ষার যথাযথ প্রয়োগ এবং নারীর নিরাপত্তা বিধানে। ধর্ষণ, নির্যাতন, যৌন হয়রানি এবং নিপীড়ন যখন দেশের প্রতিটি জেলায় নিত্যদিন ঘটে চলেছে, তখনও রাষ্ট্র অপরাধীদের বিচারের আওতায় এনে শাস্তির ব্যবস্থা করতে ব্যর্থ।
এমনকি যখন ক্ষমতাসীন দলের সদস্য থেকে শুরু করে বিত্তশালী পুরুষ এবং সামরিক কর্মকর্তারা যৌন নিপীড়ন, ধর্ষণ ও খুনের মত অন্যায় করে গেছে, তখন সরকারকে দেখেছি তাদের অপরাধ ধামাচাপা দিতেই ব্যস্ত।
কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে তনু ধর্ষণ ও হত্যার ৮ বছর হল, পুলিশ এখনও সন্দেহভাজন কাউকে ধরতে পারেনি। মুনিয়া ধর্ষণ ও হত্যা মামলার প্রধান আসামীকে গ্রেফতার তো দূরে থাক, কখনো জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়নি। এ ধরণের ঘটনা একটা নয়, দুটো নয়, অগণিত। নারী যখন ন্যায়বিচার চায়, দ্বারে দ্বারে বিচারের আশায় ঘুরে বছর পার করে দেয়, অপরাধী ঠিকই জামিনে ঘুরে বেড়ায়।
১৫ বছরের স্বৈরাচার পতন হওয়ার পর গত ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়, আমরা আশা করি, যুগ যুগ ধরে চলে আসা এই আইনসিদ্ধ নিপীড়ন থেকে শুরু করে লিঙ্গীয় ও জাতিগত বৈষম্যমূলক রাষ্ট্রকাঠামো বিলুপ্ত ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করবেন তারাই।
ফলে ২০২০-এ ধর্ষণ বিরোধী আন্দোলনের অংশ হিসেবে ‘শেকল ভাঙার পদযাত্রা’র যে দাবিগুলো তুলে ধরা হয়েছিল, নতুন সরকারের কাছে আমরা সেসব দাবিই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে তুলে ধরছি ৪ বছর পরে আমাদের চতুর্থ শেকল ভাঙার পদযাত্রায়।
১. সারা দেশে অব্যাহত ধর্ষণ-যৌন সহিংসতার সঙ্গে যুক্তদের দ্রুততম সময়ের মধ্যে দৃষ্টান্তমূলক ও ন্যায্য শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
২. শিল্পপতি-ধনকুবেরদের নারী নিপীড়নমূলক অপরাধ বিচারের আওতায় এনে দ্রুততম সময়ের মধ্যে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। প্রয়োজনে অন্যায্যভাবে খারিজ হয়ে যাওয়া মামলাগুলো পুনঃতদন্তের ব্যবস্থা করতে হবে।
৩. ধর্ষণ মামলার ক্ষেত্রে সাক্ষ্য আইন পুনঃসংস্কার করার মাধ্যমে আইনের দিকসহ জাতি-ধর্ম-বর্ণ-বয়স-লৈঙ্গিক পরিচয় নির্বিশেষে যৌন সহিংসতার ক্ষেত্রে যেকোনোভাবেই ভিক্টিম ব্লেমিং (দোষারোপ করা/নিন্দা জানানো) বন্ধ করতে হবে।
৪. আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানদণ্ডের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আইনি ও সামাজিকভাবে ধর্ষণের সংজ্ঞায়ন সংস্কার করতে হবে।
৫. মামলার ডিএনএ আইনকে সাক্ষ্য প্রমাণের ক্ষেত্রে কার্যকর করতে হবে।
৬. সেনা প্রহরার পাহাড়ে নারীর উপর সংঘটিত সামরিক-বেসামরিক পুরুষদের যৌন সন্ত্রাসের খবরসমূহ গণমাধ্যমে আসার অবাধ প্রক্রিয়া নিশ্চিতকরণ, অভিযোগ যথাযথভাবে আমলে নেওয়া ও সুষ্ঠু বিচারের মাধ্যমে পাহাড়ে নারীর জন্য নিরাপদ পরিবেশ তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
৭. হাইকোর্টের নির্দেশানুযায়ী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সরকারি, বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানে যৌন নির্যাতনবিরোধী সেল কার্যকর ও পূর্ণ বাস্তবায়ন করতে হবে। সিডো সনদে বাংলাদেশকে স্বাক্ষর ও তার পূর্ণ বাস্তবায়ন করতে হবে।
৮. যৌন সহিংসতা প্রতিরোধে প্রান্তিক অঞ্চলের নারীদের সুবিধার্থে হটলাইনের ব্যবস্থা চালু করতে হবে। গ্রামীণ সালিশ/পঞ্চায়েতের মাধ্যমে ধর্ষণের অভিযোগ ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করতে হবে।
৯. প্রাথমিক লেভেল থেকেই পাঠ্যপুস্তকে যৌন শিক্ষা (গুড টাচ-ব্যাড টাচের শিক্ষা, সম্মতি বা কন্সেন্টের গুরুত্ব, প্রাইভেট পার্টস সম্পর্কে অবহিত করা) যোগ করার সঙ্গে সঙ্গে এর কার্যকরী পাঠদান নিশ্চিত করতে হবে।
১০. মাদ্রাসার শিশুসহ সব শিশুর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং কোনো শিশু যৌন নির্যাতনের শিকার হলে ৯০ দিনের মাঝে দ্রুততম ট্রাইব্যুনালে অভিযোগের সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিত করতে হবে।
১১. কোনো নারী নিপীড়নের শিকার হলে অভিযোগ জানাতে গেলে থানা ও আদালতে পুলিশি ও অন্যান্য হয়রানি বন্ধ করতে হবে।
১২. গণপরিবহণে নারীদের সুরক্ষা এবং নিরাপত্তার ব্যাপারে জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করতে হবে।
১৩. ধর্মীয় বক্তব্যের নামে অনলাইনে ও অফলাইনে নারী অবমাননাকর বক্তব্য প্রচার বন্ধ করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।