মাদকাসক্তদের রক্ত বিক্রি হচ্ছে রোগীদের কাছে
ইকবাল হাসান ফরিদ
প্রকাশ: ০৫ মার্চ ২০২৪, ০১:১৫ এএম
প্রতীকী ছবি
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চলছে দালালদের দৌরাত্ম্য। প্রায় দুই শতাধিক দালাল অবাধে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে এ হাসপাতালে। কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীর সঙ্গে যোগসাজশ করে তারা চালিয়ে যাচ্ছে রোগী ভাগানো, আইসিইউ বাণিজ্য, টেস্ট ও রক্ত বাণিজ্যসহ নানা অপতৎপরতা।
জানা গেছে, ঢামেক হাসপাতালকে ঘিরে আশপাশের এলাকায় গড়ে উঠেছে নামে বেনামে বিভিন্ন ক্লিনিক ও ডজনখানেক ব্লাড ব্যাংক। এসব ব্লাড ব্যাংকে রাতে ভাসমান মাদকাসক্তদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয় রক্ত। এসব রক্ত রাখা হয় মাছ সংরক্ষণের ককসিট বক্সে বরফ দিয়ে। পরে ওই রক্ত দালালদের মাধ্যমে বিক্রি করা হয় ঢামেক হাসপাতালে ভর্তি বিভিন্ন রোগীর স্বজনদের কাছে।
সোমবার এ হাসপাতালে অভিযান চালিয়ে অর্ধশতাধিক দালালকে আটকের পর তাদের কয়েকজনের জবানিতে বেরিয়ে আসে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য। এছাড়া রোগীদের বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা দালালরা বাইরে থেকে করায়। আইসিইউর জন্য মুমূর্ষু রোগীদের ভাগিয়ে নেওয়া হয় বিভিন্ন প্রাইভেট ক্লিনিকে।
এ হাসপাতালে আসা ভুক্তভোগী রোগী ও স্বজনরাও যুগান্তরকে জানিয়েছেন পদে পদে দালালদের মাধ্যমে নানা হয়রানির অভিজ্ঞতার কথা।
লক্ষ্মীপুরের রায়পুরের ব্যবসায়ী হোসেন আহমেদ (৭০) ২৯ ফেব্র“য়ারি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হন। আইসিইউ সাপোর্ট লাগবে জানিয়ে তাকে স্থানীয় হাসপাতাল থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। হোসেন আহমেদের ছেলে জাকির হোসেন জানান ঢাকা মেডিকেলে এসে দালালদের হয়রানির কথা।
তিনি বলেন, সন্ধ্যায় ঢাকা মেডিকেলের জরুরি বিভাগের সামনে এসে অ্যাম্বুলেন্স থামানো হয়। বাবাকে নামানোর জন্য কোনো স্ট্রেচার খুঁজে পাচ্ছিলাম না। এক দালাল বললেন, ট্রলি আছে, টাকা লাগবে দুইশ। ওই পরিস্থিতিতে আমি ২০০ টাকা দিতে রাজি হই। পরে ইমার্জেন্সি চিকিৎসকের রুমের সামনে নিতে তাকে আরও ১০০ টাকা দিতে হয়।
চিকিৎসকের পরামর্শে নতুন ভবনের নিচে সিটিস্ক্যান করিয়ে বের হয়ে আসার পর ওই ব্যক্তি আমার কাছে আরও এক হাজার টাকা দাবি করেন। তিনি নানাভাবে দুর্ব্যবহার করেন। পরে আমরা তাকে আরও ৭০০ টাকা দিতে বাধ্য হই। এরপর বাবার আইসিইউ লাগবে জানতে পেরে ওই ব্যক্তি আমাদের প্রাইভেট হাসপাতালে আইসিইউতে নিয়ে যেতে প্রলুব্ধ করার চেষ্টা করেন। ততক্ষণে তাকে প্রতারক ভেবে আমরা এড়িয়ে যাই।
আরেক রোগীর স্বজন গাজীপুরের রহিমা বেগম জানান, তার মায়ের এবি পজেটিভ রক্তের প্রয়োজন হলে এক দালাল জানান তিনি রক্ত এনে দেবেন।
এজন্য তিন হাজার টাকা লাগবে। তিন হাজার টাকা দিয়ে রক্ত এনে দেখি এটি দূষিত। এরপর আর ওই দালালের দেখা পাইনি। শুধু এই দুই ভুক্তভোগীই নন, এ হাসপাতালে আসা রোগীরা পদে পদে দালালদের খপ্পরে পড়ছেন। হাসপাতালের ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে নির্বিঘেœ ঘুরে দালালরা রোগীদের টেস্টের স্যাম্পল সংগ্রহ করে। এভাবে তারা লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।
অপর একটি সূত্র জানিয়েছে, আইসিইউর রোগী ভাগানোর একটি শক্তিশালী চক্র সক্রিয় রয়েছে এ হাসপাতাল ঘিরে। রাত ১২টার পর থেকে ভোররাত পর্যন্ত এরা এ হাসপাতাল থেকে আইসিইউর রোগী ভাগিয়ে বিভিন্ন হাসপাতাল ক্লিনিকে নিয়ে যায়। বিনিময়ে তারা পায় মোটা অঙ্কের কমিশন।
এসব বিষয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপপরিচালক (পরিচালক ছুটিতে থাকায় ভারপ্রাপ্ত হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন) ডা. নুরুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, আমরা সবসময়ই অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা ও দালালচক্র রুখতে জিরো টলারেন্স নীতি অবলম্বন করছি। এ বিষয়গুলোও খতিয়ে দেখব। আমাদের কোনো কর্মচারীও যদি জড়িত থাকেন তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব।
এর আগে সোমবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা এনএসআইর সহযোগিতায় ঢামেক হাসপাতালে দালালবিরোধী অভিযান চালায় র্যাব-৩। অভিযানের পর ৫৮ দালালকে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে সর্বনি¤œ ১৫ দিন ও সর্বোচ্চ এক মাস সাজা দেওয়া হয়।
অভিযানের বিষয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বাগান গেটে বেলা ৩টায় সংবাদ সম্মেলন করেন র্যাব-৩ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আরিফ মহিউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, এ হাসপাতালে আসা রোগীদের ভর্তিসহ বিভিন্ন কাজে হয়রানির মাধ্যমে অর্থ আদায় এবং কমিশন লাভের জন্য রাজধানীর বিভিন্ন ব্যয়বহুল বেসরকারি হাসপাতালে রোগী পাঠানোর সঙ্গে জড়িত দালালদের গ্রেফতার করা হয়েছে।
স্বাস্থ্যমন্ত্রীর নির্দেশনায় আমাদের এ অভিযান চলমান থাকবে। এর আগেও আমরা এ হাসপাতাল থেকে দালালদের গ্রেফতার করেছি। তারা জামিনে বেরিয়ে এসে আবারও আগের পেশায় জড়িয়েছে। আমরা এক মাস গোয়েন্দা নজরদারি করে এ অভিযান পরিচালনা করেছি।