ফাইল ছবি
নিঃসন্তান পারুল বেগম ও ফিরোজ আলম দম্পতি এক মাস বয়সে মো. পারভেজ আহম্মদকে দত্তক নেন। নিজের সন্তানের মতোই লালন-পালন করেন তাকে। ১৯ বছর বয়সে কাজের সন্ধানে লক্ষ্মীপুর সদর থানার উত্তর হামছাদী গ্রাম থেকে রাজধানীতে আসেন পারভেজ। মিরপুর এক নম্বরের শাহআলী মার্কেটের একটি কাপড়ের দোকানে বিক্রয়কর্মীর চাকরি নেন। বৃদ্ধ মা-বাবার খরচ জোগাতেন তিনি। কিন্তু হঠাৎ বদলে যান পারভেজ, চলে যান আত্মগোপনে। মা-বাবাকে নিয়মিত খরচ দিলেও বাড়িতে যাওয়া বন্ধ করে দেন। আত্মগোপনের বছর দুই পর রাজধানীর শাহআলী থানাধীন নিউসি ব্লকের ২৫ নম্বর সড়কের একটি ভবনের তৃতীয় তলার রুম থেকে পারভেজের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। হত্যাকাণ্ডের পর স্বজনরা জানতে পারেন পারভেজ হিজড়া দলে যোগ দিয়ে ‘চিমা হিজড়া’ নাম ধারণ করেছিলেন।
২০২১ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর রাতে ঘটা ওই হত্যাকাণ্ডের পরদিন শাহআলী থানায় অজ্ঞাত ব্যক্তিদের আসামি করে মামলা করেন পারভেজের মামাতো ভাই ইসমাইল হোসেন সুমন। টানা দুই বছরের বেশি সময়ের তদন্তেও পুলিশ হত্যাকারীদের খুঁজে বের করতে পারেনি। শাহআলী থানা পুলিশের তদন্তে সন্দেহভাজন তিন খুনি গ্রেফতার হলেও পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) তদন্তে তারা অব্যাহতি পেয়েছেন। হত্যাকারী শনাক্তের সম্ভাবনা নেই উল্লেখ করে সম্প্রতি আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে পিবিআই। ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ‘পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্যপ্রমাণ পাওয়া গেলেও তদন্তকালে গ্রেফতার হওয়া আসামি মো. শাহরিয়ার কামাল ওরফে শোভা হিজড়া, মো. তানভীর ওরফে তানিয়া হিজড়া এবং মো. সাইফুল ইসলাম ওরফে পাখি হিজড়া ভুক্তভোগীকে (পারভেজ) হত্যা করেছে মর্মে ঘটনা প্রমাণ করার মতো কোনো প্রত্যক্ষ ও সুনির্দিষ্ট সাক্ষ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়নি এবং আশু হত্যাকারী শনাক্তের সম্ভাবনা নেই।’
চলতি মাসের মাঝামাঝি চূড়ান্ত প্রতিবেদন আদালতে উপস্থাপনের দিন ধার্য রয়েছে বলে জানিয়েছেন শাহ আলী থানার জিআরও উপপরিদর্শক আল মামুন। জানতে চাইলে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআইর পরিদর্শক নূরননবী সরকার যুগান্তরকে বলেন, ‘এ হত্যার প্রকৃত কারণ জানা যায়নি। প্রথম থেকেই থানা পুলিশ অসামাজিক কার্যকলাপকে কেন্দ্র করে হিজড়াদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বকে প্রাধান্য দিয়ে তদন্ত করেছে। তদন্ত করতে গিয়ে মাদকসংক্রান্ত বিষয়ও সামনে আসে। তবে তথ্যপ্রমাণ না পাওয়ায় তদন্তে বেশি দূর অগ্রসর হওয়া যায়নি।’
গ্রেফতারকৃতদের সঠিকভাবে জিজ্ঞাসাবাদও করা যায়নি দাবি করে পরিদর্শক নূরননবী বলেন, ‘৩ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের আবেদন করলে আদালত জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দেন।’ পিবিআইয়ের তদন্ত প্রতিবেদন নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে মামলার বাদী ইসমাইল হোসেন সুমন বলেন, ‘পুলিশ হত্যাকারীকে খুঁজে পায় না এটা বিশ্বাস করা যায় না। খুন হওয়ার কয়েকদিন আগে পারভেজ তার মাকে ফোন করে বলেছিল, ঢাকায় আর ভালো লাগে না। একেবারে বাড়িতে চলে আসব।’
বিচারের আশা ছেড়ে দিয়ে সুমন বলেন, ‘পারভেজের মা-বাবা বৃদ্ধ ও অসুস্থ। তারা নিজেরাই আর্থিক অনটনে থাকেন। আমি নিজেও আর্থিক সংকটে। ফলে মামলা চালানোর মতো অবস্থা আমাদের নেই।’
সূত্র জানায়, শাহআলী থানা পুলিশ মামলাটি তদন্তকালে সন্দেহভাজন হিসাবে একই ভবনের হিজড়া বাসিন্দা মো. শাহরিয়ার কামাল ওরফে শোভা, মো. তানভীর ওরফে তানিয়া ও মো. সাইফুর ইসলাম ওরফে পাখিকে গ্রেফতার করে। মামলাটি পুলিশ সদর দপ্তরের নির্দেশে ২০২১ সালের ১২ ডিসেম্বর তদন্তের দায়িত্ব পায় পিবিআই।
তদন্তকালে পিবিআই জানতে পারে, গ্রাম থেকে ঢাকা এসে পারভেজ মিরপুর ১ নম্বর শাহআলী মার্কেটের আন্ডারগ্রাউন্ডে লিটনের কাপড়ের দোকানে বিক্রয়কর্মী হিসাবে কাজ করেন। খুন হওয়ার ৪ বছর আগে ওই দোকানের চাকরি ছেড়ে হিজড়াদের দলে যোগ দেন। পারভেজ ওরফে চিমা হিজড়া প্রথমে তানিয়া হিজড়ার শিষ্য ছিল। তানিয়ার হয়ে সে এলাকায় চাল উঠাত। পরে তাদের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ হলে পারভেজ ওরফে চিমা পরে স্বপন হিজড়ার শিষ্য হয়ে এলাকায় টাকা ও চাল উঠাত। ফলে তানিয়া হিজড়ার সঙ্গে তার কয়েকবার ঝগড়া হয়। এছাড়া পারভেজ ওরফে চিমার সঙ্গে শোভা হিজড়ার সম্পর্ক ভালো ছিল না। তাদের মধ্যে অতীতে কয়েকবার হাতাহাতি ও মারামারি হয়।