‘ক্ষমতাসীনের বিপরীতে কথা হলেই জেলজুলুমে জ্ঞানের বিকাশ হয় না’
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১০:০৬ পিএম
অবাণিজ্যিক শিক্ষাব্যবস্থা প্রথম চাওয়া। শ্রেণিবৈষম্যের ঊর্ধ্বে সর্বজনীন এক শিক্ষাব্যবস্থা চাই। যেখানে রাষ্ট্র অর্থ জোগাবে, নিয়ন্ত্রণ করবেন বিশেষজ্ঞরা। স্বাধীনতার ৫২ বছরেও শিক্ষা সর্বজনীন হয়নি। প্রাথমিকেই শিক্ষাব্যবস্থা বহুধারায় বিভক্ত। এসএসসি বা সমমানের পরীক্ষা থেকে প্রাপ্ত সার্টিফিকেটেও মানের তারতম্য রয়েছে। কোনো কোনো মাধ্যমে সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেই। দেশে বিজ্ঞানচর্চার আবহ নেই, মানবিকবিদ্যা চর্চার মুক্ত পরিবেশ নেই। ফলে শিক্ষাব্যবস্থায় বৈষম্য বাড়ছে।
শনিবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে ‘সর্বজনীন গণমুখী বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষানীতি : বর্তমান প্রেক্ষিতে নাগরিক ভাবনা’ শীর্ষক এক সেমিনারে বক্তারা এসব কথা বলেন। জাতীয় শিক্ষা-সংস্কৃতি আন্দোলন আয়োজিত সেমিনারে মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক কাবেরী গায়েন।
কাবেরী গায়েন বলেন, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সৃজনশীল বিকাশের জন্য চাই রাষ্ট্রের উদ্যোগ। দেশে শিক্ষাক্ষেত্রে এখনো রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যেও সবচেয়ে কম। ক্ষমতাসীনের বিপরীতে কথা হলেই যদি জেলজুলুম হয়, সেখানে জ্ঞানচর্চার বিকাশ হতে পারে না। অর্থাৎ শিক্ষানীতি ও শিক্ষাদর্শন হবে গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক, বিজ্ঞানভিত্তিক ও স্বাধীন। দেশে প্রচলিত মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থা মূলত বিশ্বাসভিত্তিক। এখানকার কারিকুলামের ওপর সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণও নেই।
তিনি বলেন, কওমি মাদরাসার দাওরায়ে হাদিসের সনদকে মাস্টার্স ডিগ্রির সমমান প্রদান আইন-২০১৮ এর জন্য ছয়টি শিক্ষা বোর্ডকেও স্বীকৃতি দিয়েছে সরকার। এছাড়া হাফেজিয়া, ইবতেদায়ি, ফোরকানিয়া মাদরাসাগুলো বাংলাদেশ মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের আওতায় শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষার্থী রয়েছে। ফলে সঠিক শিক্ষার্থী সংখ্যা জানা কঠিন।
২০১০ সালে প্রণীত বর্তমান শিক্ষানীতি শিশুদের শারীরিক-মানসিক বিকাশে জুতসই নয় বলেও মন্তব্য করেছেন কাবেরী গায়েন।
তিনি বলেন, অনেক সম্ভাবনা সত্ত্বেও ২০১০ সালের শিক্ষানীতি সঙ্গে নিয়েই বাংলাদেশে গত ১২ বছরে শিক্ষা খাতের সমস্যা প্রকটতর হয়েছে। এ নীতি প্রণয়নে সংশ্লিষ্টরা অবশ্য ঘোষিত নীতির অনেক সুপারিশ যথাযথভাবে বাস্তবায়িত না হওয়াকেই দায়ী করেন।
কাবেরী গায়েন বলেন, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যে এক বছরের প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয় চালু করার কথা ছিল, তা এখনো চালু করা হয়নি। বরং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এনজিও বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান দিয়ে চালানো হয়, যা হয় খুব ব্যয়বহুল নয়তো নীচুমানের সেবা প্রদানকারী। এক কথায় এ শিক্ষানীতি শিশুদের মানসিক-শারীরিক বিকাশের জন্য জুতসই নয়।
তিনি আরও বলেন, অবকাঠামোর অভাবে সর্বজনীন এবং বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্থগিত করা হয়েছে। আবার পঞ্চম শ্রেণি শেষ করে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা এবং অষ্টম শ্রেণি শেষ করে জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা (জেএসসি) চালু হওয়ায় প্রক্রিয়াটি আরও জটিল হয়েছে। প্রথম থেকেই বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করে আসছেন যে, ১১-১২ বছর বয়সে পাবলিক পরীক্ষায় বসলে শিশুদের ওপর ক্ষতিকর মানসিক চাপ তৈরি হতে পারে এবং তা তরুণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে অস্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতার সৃষ্টি করতে পারে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক জোবাইদা নাসরিন বলেন, তৎকালীন উচ্চশিক্ষার দর্শন মুক্তিকামী ছিল বলেই স্বাধীন রাষ্ট্রের জš§ হয়েছে। বর্তমানে সাম্প্রদায়িকতা ও বৈষম্য শিক্ষানীতিকে গ্রাস করেছে। আধুনিক রাষ্ট্র গঠনে গণমুখী অবাণিজ্যিক শিক্ষাই সর্বপ্রথম শর্ত।
গণসংগীতশিল্পী ও নাগরিক অধিকারকর্মী মাহমুদ সেলিমের সভাপতিত্বে সেমিনারে আরও বক্তব্য রাখেন কথাসাহিত্যিক মঈনুল আহসান সাবের, বাংলাদেশ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আকমল হোসেন, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক আলী আকবর, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাবেক সাধারণ সম্পাদক রাজু আহমেদ প্রমুখ।